ট্রেনের দখল নিয়েছে আনাজের বস্তা। নিজস্ব চিত্র
সিটের উপরে কাঁচা লঙ্কার বস্তা। যাত্রীরা ঠায় দাঁড়িয়ে। বস্তা সরালেও বসার অবশ্য জো নেই। ভেজা বস্তার তলা থেকে সিট বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জল। দরজা আটকে কাঁচা লঙ্কা, আদা, রসুন, বরবটি, পেয়ারা, গাজর, উচ্ছে, টোম্যাটোর বস্তা ডাঁই করা। খালি নেই উপরের বাঙ্কও। ঝাঁঝে যাত্রীদের চোখ জ্বলছে। নাকে চাপা রুমাল বা আঁচল।
এটাই রোজকার চেনা ছবি পূর্ব রেলের লালগোলা-রানাঘাট শাখার দু’টি ইএমইউ ট্রেন আর লালগোলা-শিয়ালদহ দু’টি প্যাসেঞ্জারে। সকালের ইএমইউ ট্রেন লালগোলা ছেড়ে ভগবানগোলা স্টেশনে আসতেই হুড়মুড় করে আনাজ ব্যবসায়ীরা উঠে পড়ে যাত্রী কামরায়। পরে জিয়াগঞ্জ থেকে যাত্রীরা উঠে দেখেন গোটা কামরা বস্তার দখলে।
জিয়াগঞ্জের নিত্যযাত্রী মৃন্ময় সরকারের অভিযোগ, ‘‘বারো বগির ট্রেনে ভেন্ডার কামরা রয়েছে। কিন্তু তা ফাঁকা রেখে আনাজ ব্যবসায়ীরা বেছে নেন যাত্রী কামরা। রেলপুলিশ থেকে সিআরপি সব কিছু জেনেও নির্বিকার।’’ হুবহু একই অভিজ্ঞতা বেলডাঙার সেলিম রেজার। তিনি জানাচ্ছেন, যাত্রী কামরায় শৌচালয়ের পাশে তো আনাজে ঝুড়ি রাখা থাকছেই, এমনকী জিনিসপত্র রাখার জায়গাতেও লঙ্কা ভর্তি বস্তা এনে রেখে দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা দলে ভারী থাকায় কিছু বলা যায় না। কার্যত একই অভিজ্ঞতা হরিহরপাড়ার মহম্মদ ইকবালের।
আনাজ ব্যবসায়ী সাগির হোসেন বলেন, ‘‘রেজিনগরে শনিবার, বেলডাঙায় মঙ্গলবার, কৃষ্ণনগরে বৃহস্পতিবার এবং দেবগ্রামে রবিবার হাট বসে। আনাজ নিয়ে যাওয়া হয়। ভেন্ডার কামরা বন্ধ থাকে বলে বাধ্য হই যাত্রী কামরায় নিয়ে যেতে।’’ ব্যবসায়ী নিশীথ মণ্ডলের ব্যাখ্যা, ইএমইউ ট্রেনে একটা ভেন্ডার কামরা। ব্যবসায়ী ৩০-৩৫ জন, প্রত্যেকের কাছে দু’টি করে বস্তা, ভেন্ডারে তা আঁটে না।’’
লালগোলা-শিয়ালদহ ট্রেন আবার তাহেরপুর ঢুকতেই কামরায় উঠতে থাকে আনাজের বড়-বড় ঝুড়ি। তাতে বেগুন, পটল, লঙ্কা। বিরক্তি প্রকাশ করে লাভ নেই। আনাজ ব্যবসায়ীরা উল্টে চার কথা শুনিয়ে দেবেন। সন্ধের পরে কৃষ্ণনগর ছেড়ে যাওয়া ট্রেনে বাদকুল্লা, তাহেরপুর, বীরনগর, চাকদহ থেকে উঠতে থাকে আনাজ। নিত্যযাত্রী অরিন্দম দেবের বিস্ময়, “দীর্ঘদিন ধরে এটা চলে আসছে। রেল কর্তারা কেন দেখতে পান না, সেটাই বুঝতে পারি না।”
বেঙ্গল রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, লালগোলা-শিয়ালদহ শাখায় ১৫ জোড়া ট্রেন চলাচল করে। তার মধ্যে ৬ জোড়া ট্রেনের ‘কনভেনশনাল রেক’ আছে। ওই ট্রেনগুলিতে ভেন্ডার কামরা থাকা সত্ত্বেও সেগুলিতে ব্যবসায়ীরা ছানা থেকে শুরু করে লঙ্কা, পেয়ারা-সহ নানা আনাজ ও ফল নিয়ে ওঠেন। কাঁচা লঙ্কার ঝাঁজে বসে থাকা যায় না।
বেঙ্গল রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক পুণ্ডরীকাক্ষ কীর্তনিয়া বলেন, “এর আগে আমরা একাধিক বার রেল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছি। কিন্তু রেল কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে যাত্রী কামরা লঙ্কা-সহ অন্যান্য সব্জি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যায়।” তাঁর দাবি, শুধু লালগোলার দিক থেকে কলকাতায় আনাজ যায় এমন নয়, এ দিকেও কিছু আনাজ ট্রেনে করে আসে। ফলে যাতয়াতে খুব সমস্যা হয়।
বহরমপুরের নিত্যযাত্রী সংগঠন প্রোগ্রেসিভ রেলওয়ে যাত্রী সেবা সমিতির সম্পাদক মলয়কুমার বণিকও জানান, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা শিয়ালদহ শাখার ডিআরএম-কে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু লাভ হয়নি।
পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র অবশ্য দাবি করেন, ‘‘বিষয়টি আমার জানা নেই। গোটা বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ করা হবে।’’
কবে হয়, সেটাই দেখার।