রং-রিপুর কার্গিলে যুদ্ধ নেই

প্রশ্নটা শুনেই কপালে ভাঁজ পড়ল লোকটির— কেন দাদা, কলকাতায় যে ‘মরা সাহেবের’ জামা-প্যান্ট বলে যে গুলো বিক্রি হয়, সেগুলো বুঝি পুরনো নয়!’’

Advertisement

সুস্মিত হালদার

শান্তিপুর শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৬ ০১:৩৩
Share:

পুরনো ফের নতুন হয়ে উঠছে। গোবিন্দপুরে ব্যস্ত কার্গিল-শিল্পীরা।

প্রশ্নটা শুনেই কপালে ভাঁজ পড়ল লোকটির— কেন দাদা, কলকাতায় যে ‘মরা সাহেবের’ জামা-প্যান্ট বলে যে গুলো বিক্রি হয়, সেগুলো বুঝি পুরনো নয়!’’

Advertisement

হক কথা। বাঁকা প্রশ্নে বিরক্তি তাঁর উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কলকাতায় পুরনো জামা-শাড়ি থেকে শালোয়ার মায় গেঞ্জিও তো দিব্যি বিকিকিনি হয়, ধোপ-দুরস্ত সেই সব জামা ‘মরা সাহেবের’ জামা বলেই পরিচিত।

রয়েছে পুরনো কাপড়চোপড়ের বদলে স্টিলের থালা বাসন কিংবা প্লাস্টিকের বালতি-গামছা নেওয়ার চলনও। তাহলে শান্তিপুরের প্রান্তিক গলিতে ‘কার্গিল’ কী দোষ করল!

Advertisement

শান্তিপুরের পরিচিত তাঁত মহল্লার অদূরেই তাই, কেচে, ডাই (মেশিনে শুকিয়ে) করার পরে দিব্যি রংচঙে সস্তার শড়ি-জামা বাজার মাত করেছে। কার্গিলের কারবারিরা বলছেন, ‘‘আপনার পুরনো জামা সস্তায় কিনে রং করে এমন নতুন করে দেব যে দিব্যি বছর দুয়েক পড়বেন আপনি।’’

আর সেই ব্যবসায় বোলবোলাও শান্তিপুরের হরেক মহাজনের।

রাতারাতি লাখপতি হয়ে যাওয়া এক কার্গিল ব্যবসায়ী তাঁর পেল্লাই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন, ‘‘নতুন শাড়ির সঙ্গে পার্থক্য করে দেখান তো। দেখি কেমন ক্ষমতা?

চ্যলেঞ্জটা নিলে গোবিন্দপুর এলাকায় গেলেই ঠকতেই হবে। শান্তিপুরের কাছেই ৩৪ নম্বর সংলগ্ন গোবিন্দপুরে বিবেকানন্দনগর, সুকান্তপল্লি, কুতুবপুর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই কার্গিল ব্যবসা। গ্রামের মাঠে ঘাটে শুকোতে দেওয়া হয়েছে শয়ে শয়ে নানান রঙের পুরনো রং করা শাড়ি।

বিভিন্ন জায়গা‌ থেকে পুরনো কাপড় কিনে এনে রঙ করে, সেলাই, রিপু ও অ্যাপলিক-এমব্রডয়ারির কাজ করা হয়। তারপরে কড়া সাবুর মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করে অবিকল নতুন শাড়ির চেহারা দিয়ে নানান ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাজারে। কার্গিল শাড়ি।

কিন্তু কার্গিল কেন?

স্থানীয় মহাজনেরা বলছেন, ব্যবসাটা শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সাল নাগাদ, তখন কাশ্মীরের পাহাড়ে চলছে কার্গিলের যুদ্ধ। সময়টা ধরে রাখতেই শাড়ির নামকরণ। এক মহাজন বলছেন, ‘‘আসলে সেই সময়ে যাই করবেন, তারই নাম হয়ে যেত কার্গিল। রোলের দোকাল থেকে শাড়ি— কোনওটাই বাদ যেত না।’’

তবে স্থানীয় বাসিন্দারা নামকরণের পিছনে অন্য একটা কারণও বলছেন— কার্গিলের যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকায় পাঠানোর জন্য সেই সময়ে বহু মানুষ শাড়ি-জামাও দিয়েছিলেন। তার সব কী আর, কার্গিলে পাড়ি দিয়েছিল! যা পড়েছিল তা দিয়েই শুরু হয়েছিস ব্যবসা।’’

প্রতি দিন গোবিন্দপুর এলাকা থেকে ট্রাক বোঝাই হয়ে ওই সস্তার শাড়ি পাড়ি দিচ্ছে বিহার, ঝাড়খণ্ড, এমনকী প্রত্যন্ত ওড়িশায়। সেখান থেকে হাত বদল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নিম্নবিত্তের হাতে।

স্থানীয় বাজারে, বড় শহরের হকাররা ট্রেনে-বাসেও তা বিক্রি করেন বলে জানা গিয়েছে। শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ির নামে দেদার বিকোও তা। নিতান্তই কম দামে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সতেরো বছর আগে শুরু হওয়া গোবিন্দপুরের ওই ব্যবসায় অন্তত হাজারখানেক পরিবার জড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের উপরে আবার নির্ভরশীল কয়েকশো অনুসারি শিল্পের মানুষ। রং, রিপুর কারিগরের ওই শিল্প থেকেই আয় করছেন এখন।

সুতো সুতো, ‘কার্গিল’ শাড়ির অন্যতম বড় মহাজন শা‌ন্তনু দাস বলেন, ‘‘এই শাড়ি পশ্চিমবঙ্গে তেমন বিক্রি হয় না। বেশির ভাগটা চলে যাচ্ছে বাইরের রাজ্যে। আমিই যেমন ঝাড়খণ্ডের পাশাপাশি দিল্লিতে পাঠাই। ভালই দাম মেলে।’’ তিনি জানান, দাম ঠিক হয় শাড়ির ‘কোয়ালিটির’ উপরে। যে শাড়ির যেমন ‘কোয়ালিটি’ তার দাম তেমন।

কি ভাবে? ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্টিলের বাসনের পরিবর্তে তাঁত ও সূতির শাড়ি নিয়ে সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন হকাররা। আমাদের জেলার কালীনগর, বীরনগরের পাশাপাশি ব্যান্ডেল, কোন্নগর ও কলকাতার গিরিশপার্ক এলাকা থেকে নিয়ে আসা হয় পুরনো শাড়ি। এর ভিতরে যেমন রঙ ওঠা পুরনো ছেড়া শাড়ি থাকে তেমনই থাকে ভাল শাড়িও।

ভাল শাড়ি? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিতেই এক রঙের ‘লেবারের’ কথায়, ‘‘হবে না কেন? অনেক অবস্থাপন্ন বাড়িতেই বার কয়েক পরা শাড়ি-জামা, কিংবা পছন্দ না হওয়া শাড়ি দিয়ে বাসন কিনে নেন।’’ শাড়িতে কাটা-ফাটা থাকলে তার উপরে একাধিক মানানসই অ্যাপলিক বা এমব্রডয়ারির কাজ করা হয়। তাতেও শাড়ির চেহারাই খুলে যায়। তারপর সেটাকে নতুন শাড়ির মতো ভাঁজ করে ইস্ত্রি করে বিক্রির মুখে কে বলবে যে, এটা পুরনো কার্গিলের স্মৃতি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement