রাস দেখতে পর্যটকের আনাগোনা নবদ্বীপে। সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
শেষ পর্যন্ত আশঙ্কটা সত্যি হল!
নবদ্বীপের রাসে এক ধাক্কায় পর্যটকের সংখ্যা কমে গিয়েছে অনেকটাই। সৌজন্যে ৫০০ ও এক হাজার টাকার অচল নোট।
হোটেল, মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের দাবি, অন্য বারের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ লোক কমে গিয়েছে এ বারের রাসে। ফলে নোটের ঘায়ে যেমন পর্যটক হারাল নবদ্বীপের রাস। তেমনি ব্যবসায়ীদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ। তাঁরা জানাচ্ছেন, পথেঘাটে, পুজো মণ্ডপে যেটুকু ভিড় দেখা যাচ্ছে তাঁরা সকলেই স্থানীয়। কিন্তু যে বহিরাগত দর্শনার্থীদের উপস্থিতি দিয়ে বিচার করা হয় রাস কেমন জমল সেই তাঁরা এ বারে নেই বললেই চলে।
রাতারাতি ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করার জের রাসের উপর পড়তে পারে বলে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন নবদ্বীপের ব্যবসায়ী ও মঠ-মন্দিরের প্রধানেরা। কিন্তু তখনও তাঁরা ভেবেছিলেন, এই ক’দিনে পরিস্থিতি হয়ত কিছুটা বদলাতে পারে। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, ব্যাঙ্কের সামনে লাইনও হয়েছে দীর্ঘতর। বেশির ভাগ এটিম কাউন্টারের সামনে ঝুলেছে ‘নো ক্যাশ’ লেখা বোর্ড। আর তাই রবিবার ও সোমবার নবদ্বীপে রাস উৎসব চলল ঠিকই। কিন্তু ভিড়ে ভাসতে পারল না চৈতন্যধাম।
পর্যটনের উপর নির্ভরশীল নবদ্বীপের অর্থনীতি অনেকটাই মজবুত করে এই রাস। অথচ শহরের সবচেয়ে বড় এই উৎসবের মুখে নোট বাতিলের ঘটনায় নবদ্বীপের স্থানীয় অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেল বলেই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় বাজার থেকে খুচরো, পাইকারি সর্বত্রই এই হতশ্রী চেহারাটা বেশ প্রকট।
নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলছেন, ‘‘মানুষের হাতে নগদ টাকা ক্রমশ কমে আসছে। পাঁচশো, হাজার টাকার নোট বাতিল। একশো টাকার নোটও রয়েছে নামমাত্র। এই অবস্থায় লোকে চাল-ডাল-তেল-নুন কিনবেন, না উৎসবে বেড়াতে আসবে? আমার বাহাত্তর বছর বয়সে রাসের এমন চেহারা কোনওদিন দেখিনি মশাই।” তাঁর সংযোজন, বাজারের অবস্থা খুব খারাপ। বহু দোকানে বউনি পর্যন্ত হচ্ছে না। অনেকে দোকান খুলছেন না। পরিস্থিতি কোন দিকে যে যাবে, কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।
নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত আসেন। তাঁদের রাত্রিবাসের জন্য অতিরিক্ত ছাউনির ব্যবস্থা করতে হয়। এ বার সে সব কিছুই নেই। ভক্ত সমাগম বেশ কম। নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “নবদ্বীপের সব থেকে বড় উৎসবের এমন ছবি আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। লোকজন খুব কম এসেছেন। যাঁরা এসেছেন তাঁদের কাছেও নগদ টাকার বড় অভাব।”
নবদ্বীপের অন্যতম ব্যস্ত মঠ বলদেব জিউ মন্দিরের কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী বলছেন, ‘‘ভক্তেরা আসবেন কী করে? মঠ-মন্দিরে যাঁরা আসেন তাঁরা পুজো প্রণামী কিছুই দিতে পারছেন না। উল্টে আগরতলা থেকে সপরিবার এক ভক্ত এসেছিলেন। তাঁকেই হাজার টাকার ছোট নোটের ব্যবস্থা করে দিতে হল। যার ফল অন্য বার রাসের দিন যেখানে দু’শো মানুষের থাকার ব্যবস্থা করতে হয়, এ বার সেখানে মাত্র ষাট জন ভক্ত আসতে পেরেছেন।’’
নবদ্বীপের অন্যতম প্রাচীন শক্তিমূর্তি শবশিবা মাতার পুজো হয় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। সেই পুজোতেও খুঁটিনাটি উপাচার জোগাড় করতে নাজেহাল হতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের।
নবদ্বীপের কাঁসাপিতল ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততম মরসুম রাস। এ বার সেই বাসনপট্টিও সুনসান। ব্যবসায়ী দেবেশ গোস্বামীর আক্ষেপ, ‘‘লোকজনই নেই, তো ব্যবসা। এ বারে এখনও বহিরাগত কারও মুখ দেখিনি।’’ খাঁ খাঁ করছে নবদ্বীপের হোটেল, অতিথিশালাও। বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট লাগোয়া এক হোটেল মালিক প্রবীর দেবনাথ জানান, অনেকে আগে ফোন করে আসার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা আসেন নি।
সব মিলিয়ে নবদ্বীপের রাসে শুধুই নেই নেই রব।