গ্রামবাসীদের বোঝাচ্ছেন সমশেরগঞ্জের বিডিও (গলায় মাফলার)। —নিজস্ব চিত্র।
সাকুল্যে সাড়ে তিন বাই পাঁচ— পাঁচিল তোলা ছোট্ট খুপরির অন্দরে গৃহদেবতার নিশ্চুপ আবাস।
কেউ বা স্তূপীকৃত ধানের আঁতুরঘর সাজিয়েছেন নিতান্ত ওই স্বল্প পরিসরে।
ছাদ ছিল না। দেবতা কিংবা অন্ন আড়াল করতে এখন সেখানে অ্যাসবেস্টস কিংবা খোড়া চাল।
আসুন, আদ্যন্ত নির্মল গ্রামের শৌচাগারের সঙ্গে পরিচয়টা সেরে ফেলি— হ্যাঁ, ওই ঠাকুরঘর কিংবা ধানের চৌখুপ্পি গোলাটার কথাই বলছি। অন্য ব্যবহারও আছে, গরুর জাবনা, খোল রাখার গুদাম কিংবা ঘরের যাবতীয় আবর্জনার ডাঁই করে ফেলার বড়সড় চৌবাচ্চা।
হরেক রকম ব্যবহারে অভ্যস্থ নির্মল গ্রামের এমনই অজস্র শৌচাগারে আর যাই হোক শৌচকর্মটি নৈব নৈব চ!
তাঁরা এখনও মনে প্রাণে স্বস্তি বোধ করেন ওই অনন্ত প্রান্তরে।
আগল খোলা প্রান্তর।
ইতস্তত ঝোপঝাড়, নাড়ায় গেঁজে ওঠা মাঠের অন্তে হয়তো বা বাঁশ-ঘাসের ঝাড়। পলি-নালা-কাদা।
ভোরের সেই মাঠে সার দিয়ে নারী-পুরুষ, নির্বিবাদে সেরে নিচ্ছেন প্রাতঃকৃত্য।
বছর দেড়েক আগেই, নদিয়া জেলাকে উন্মুক্ত শৌচবিহীন জেলা হিসাবে ঘোষণা হয়েছে। দেশের মধ্যে প্রথম উন্মুক্ত শৌচবিহীন জেলা হিসাবে ইউনিসেফ তুলে দিয়েছে জেলাশাসকের হাতে সুদৃশ্য পুরষ্কার। তবে, বছর ঘোরার আগে সেই সব সাড়ে তিন বাই পাঁচ আমুল বদলে গিয়েছিল ওই ঠাকুরঘর কিংবা ধানের মিনি গোলায়! হাল ফেরাতে গত কয়েক দিন ধরে তাই বোর বোর উঠছেন জেলার তাবড় আধিকারিকেরা। এবং উঠেই ছুটছেন মাঠে—
‘‘উঁহু মাঠে নয়, আপনার টয়লেটটা’র কী হল!’’ চমকে উঠে কেউ কাটছেন জিভ, কেউ বা হনহনিয়ে হারিয়ে যাচ্ছেন বাঁশ ঝাড়েই।
নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদের সেই বাঘা কর্তারা অবশ্য হাল ছাড়নে ওয়ালা নন। ভোরের ‘কাজে’ তখনকার মতো বাধা না দিলেও গত সাত দিন ধরে তাঁরা কিন্তু নাগাড়ে বুঝিয়ে চলেছেন— প্লিজ মাঠে নয়, রোগ বালাইয়ে মারা পড়বেন বেঘোরে। ওই টয়লেটে যান না!
শুনে সটান পাল্টা প্রশ্ন করে বসছেন এক বৃদ্ধ— ওই সব সাজানো জায়গায় ‘কাজ’ সারা যায় না।
না-কাটা ঘুম আর রাগ সামলে তাতেও কোমল গলায় বলছেন কর্তারা— ক’টা দিন যান, সব অস্বস্তি কেটে যাবে।
নদিয়া জেলাপরিষদের বিরোধী দল নেতা সিপিএমের স্বপনকুমার ঘোষ। রাগে গরগর করছেন, “আমরা আগেই বলেছিলাম, খাতায় কলমে একশো শতাংশ দেখানো হলেও অনেকের বাড়িতেই টয়লেট নেই। আর, যেগুলোয় আছে, ওঁরা ব্যবহারই করেন না!’’
নদিয়া জেলাপরিষদের সভাধিপতি বাণী কুমার রায় অবশ্য ‘জনবিরোধী’ নন। বলছেন, ‘‘যাঁদের শৌচাগার ছিল না তাঁদের প্রত্যেককে বাছাই করেছি আমরা। সাড়ে তিন লক্ষ শৌচাগার তৈরি করিয়েছি।’
তা হলে মাঠে ময়দানে কেন?
সভাধিপতি ঈষৎ ব্যাকফুটে, ‘‘সচেতনতা তো এক দিনে আসে না। কিছু শৌচালয় অকেজো-ও হয়ে গিয়েছে। হয়তো সে কারনেই...।”
কার্তিকের শেষ আঁধারে বারমুখো শৌচালয়ে যাওয়া গ্রামবাসীদের রুখতে মাঠে নেমেছেন মুর্শিদাবাদের কর্তারাও।
ফরাক্কা এলাকায় সেই ভোরের প্রহরেই মাঠ-যাত্রীদের দেখেই প্রস্ন উড়ে আসছে—
কি নাম, বাড়ি কোথায়, কি করেন, বাড়িতে লোক ক’জন? পর পর সাজিয়ে উত্তর দিলেও ঠিক ঠাহর হল না ব্যাপারটা কি । আশপাশে তাকিয়ে ভাল করে চোখ বোলালেন। নাঃ, সঙ্গে তো পুলিশও দেখছি না।
পাশ থেকে চশমা পড়া ‘সাহেবের’ প্রশ্নেই এ বার রীতিমত লজ্জায় পড়লেন সইদুল— “বাড়িতে শৌচাগার নেই ?”
“আছে তো ।”
“তাহলে গঙ্গার ঝোপের আড়ালে কেন?” আসলে স্যার ,ওখানে কেমন যেন অন্ধ-বন্ধ লাগে । তাই গঙ্গার খোলা মাঠে, একটু সুখ টান দিয়ে ......।
“গঙ্গার খোলা হাওয়া খাওয়ার অভ্যেস যে এবার বদলাতে হবে ভাই। বাড়ির শৌচাগারেই সারতে হবে নিত্যকর্ম।”
কেন এটা জরুরি, ক্ষতি কতটা মিনিট দশেক ধরে চারিদিক থেকে চলল বোঝানোর পালা। অবশেষে মিলল আশ্বাস।
“কাল থেকে আর হবে না স্যার, কথা দিলাম।” হবে তো সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে দুই ‘নির্মল’ জেলা!