প্রতীকী ছবি।
ঋতুকালীন সময়ে মেয়েরা অপবিত্র হয় না। এটা একেবারে শারীরবৃত্তীয় একটি ক্রিয়া। এর সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ির কোনও সম্পর্ক নেই। —স্কুলে প্রথম এটা শুনে অবাক হয়েছিল অষ্টম শ্রেণির সুমনা বিশ্বাস। বাড়িতে এত দিন উল্টো কথাই শুনেছে। এই সময়ে মেয়েদের ঠাকুরঘরে যেতে নেই, উনুন ছুঁতে নেই, আরও নানা রকম নিষেধাজ্ঞা। ভাবনাতেই যেন বিপ্লব হয়ে গেল তার।
নবম শ্রেণির নবনীতা ঋতুর সময়ে কাপড় ব্যবহার করত। সে সব ধোয়া-শুকোনো অত্যন্ত ধামেলার এবং অস্বস্তির। তাতে কাপড়ে দাগের সমস্যাও হয়। মা আবার বলেছেন, এমন জায়গায় কাপড় ধুয়ে শুকোতো হবে যেখানে বাড়ির ছেলেদের চোখে না পড়ে। চোখে পড়লে নাকি অমঙ্গল। স্কুলে ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিশেষ আলোচনায় উঁচু ক্লাসের দিদিরা বললেন একেবারে অন্য কথা। জানালেন, কাপড় ব্যবহারটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তাতে বিভিন্ন ধরনের রোগের আশঙ্কা থাকে, সংক্রমণ বাড়ে। এখন কম দামে ভাল মানের ন্যাপকিন মেলে। সেটা ব্যবহার করা উচিত।
ঋতুকালীন অবস্থায় কিশোরীদের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, শরীরের যত্ন নেওয়া শেখানো এবং পিরিয়ড নিয়ে যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাস ভেঙে দিতে নদিয়া জেলা প্রশাসন গত সাত মাস ধরে শুরু করেছে ‘পিঙ্ক ফ্ল্যাগ মুভমেন্ট’ বা গোলাপি পতাকা আন্দোলন। আপাতত জেলার ২৪টি স্কুলকে এই আন্দোলনের শরিক করা হয়েছে। সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়েছে।
তার পর কী ভাবে স্বল্প খরচে ন্যাপকিন সরাবরাহ বজায় রাখা যায় তা নিয়ে আলোচনায় বসেন প্রশাসনের কর্তারা। সমাধানও বের হয়েছে। ইতিমধ্যে রানাঘাট-২ ব্লকের বহুমুখী উন্নয়ন সংস্থা ও নাকাশিপাড়া ব্লকের পাটিকাবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার একটি সংস্থা ন্যাপকিন তৈরি করছে। তারা স্বল্প দরে স্কুলগুলিকে ন্যাপকিন দিচ্ছে। ‘নির্মল জেলা’র মুকুটধারী নদিয়ায় একে স্বাস্থ্য আন্দোলনের স্তরে নিয়ে যেতে চাইছে জেলা প্রশাসন। তাতে সাফল্যও মিলছে বলে জেলা সূত্রে খবর। এতে জেলা প্রশাসনকে সাহায্য করছে উৎসা নামে একটি অসরকারি সংস্থা। দিন কয়েক আগেই ‘পিরিয়ড। এন্ড অফ সেনটেন্স।’ সেরা ছোট তথ্যচিত্রে অস্কার পেয়েছে। ভারতীয় মহিলাদের ঋতুকালীন সমস্যা এর প্রতিপাদ্য। এর পরেই ঋতুকালীন ছুতমার্গ ভাঙা এবং একেবারে স্কুলস্তর থেকে মেয়েদের ঋতুচক্রের সময়ে পরিচ্ছন্নতা রক্ষার ব্যাপারে সচেতন করার বিষয়টি নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।
নদিয়ায় এই গোলাপি পতাকা আন্দোলনের নোডাল অফিসার জল ও স্বাস্থ্য বিধান বিভাগের জেলা সমন্বয়কারী শিবেন ভট্টাচার্য। শিবেনবাবু বললেন, ‘‘সুস্থ শিশুর জন্য মাকে সুস্থ হতে হবে। আর মা সুস্থ হতে গেলে একেবারে কিশোর বেলা থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতার বড় ভূমিকা রয়েছে মেয়েদের স্বাস্থ্যরক্ষায়। পুরোটাই চক্রাকারে পরস্পরের উপরে নির্ভরশীল।’’ পিঙ্ক ফ্ল্যাগ মুভমেন্টের লক্ষ্য হল, ঋতুমতী মেয়েদের ঋতুকালীন সময়ে জনস্বাস্থ্যের পাঠ দেওয়া। আর এ কাজে স্বচ্ছ ভারত মিশন, জেলা গ্রামোন্নয়ন কেন্দ্র ও জেলা পরিষদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এই কাজের জন্য প্রতিটি স্কুল থেকে কয়েক জন করে ছাত্রীকে বেছে প্রথমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষিতেরা অন্যদের বোঝাচ্ছে। আরও বেশ কয়েকটি স্কুলে কিছু দিনের মধ্যেই এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। তবে কয়েকটি স্কুল এই প্রকল্পের বাইরেও থাকলেও সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়েছে। বিধায়কের উন্নয়ন তহবিল বা স্থানীয় সাংসদদের এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে এর জন্য টাকা দেওয়া হয়েছে। যেমন, হরিণঘাটার সরযূবালা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রাখী মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘স্কুলে সাংসদ কোটার টাকায় ওই মেশিন কেনা হয়েছে। এখন মেয়েদের কাছ থেকে মাসে পাঁচ টাকা করে নেওয়া হয়। ওই সামান্য টাকার বিনিময়েই মেলে ন্যাপকিন।’’