আঠারো বছরের কমবয়সী কোনও ছেলে বা মেয়ের বিয়ে দেওয়া আইনত দণ্ডনীয়। তবুও অনেক সময়ে দেখা যায়, নাবালক বা নাবালিকার বিয়ের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এর প্রতিরোধে এ বার বাল্যবিবাহ-মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে এগিয়ে এল কালীগঞ্জ ব্লকের পলাশির নতুন পাড়া গ্রাম।
ওই পাড়ার মসজিদ কমিটির সূত্রে জানা গিয়েছে, ইসলাম রীতি অনুসারে গ্রামে কোনও মেয়ের বিয়ে হলে পাত্রীর পরিবারের সদস্য এলাকার মসজিদে এসে মসজিদ কমিটিকে তা জানাবেন। পরে সেই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে বিয়ের দিন পাত্রীর বাড়িতে কমিটির লোকজন ও মসজিদের ইমাম বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য হাজির হন। এ ছাড়াও বিয়ের সব কিছুই মসজিদের রেজিস্ট্রি খাতায় (ইসলাম ভাষায়, কাবিলনামা) লেখা হয়। তার পরেই বিয়ে সম্পন্ন হয়।
কিন্তু বিয়ের পর অনেক ক্ষেত্রেই জানা যায়, মেয়েটির বয়স আঠারো বছরের নীচে। সেই পরিস্থিতিতে মসজিদ কমিটির করণীয় কিছু থাকে না। সেই জন্যই কমিটির লোকজন বসে সিন্ধান্ত নেন, গ্রামের আঠারো বছরের নীচে কোনও মেয়ের বিয়ে হলে মসজিদের ইমাম সেই বিয়ে পড়বেন না। সম্প্রতি গ্রামে এমনই নির্দেশনামা জারি করেছেন পলাশির নতুন পাড়ার মসজিদ কমিটি।
কমিটির তরফে জানানো হয়, বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গোটা গ্রামে মাইকে করে প্রচার করা শুরু হয়েছে। যাতে গ্রামবাসীরা নাবালিকা বিয়ে রোখার বিষয়ে সচেতন হন।
বর্তমান নিয়ম অনুসারে, বিয়েতে পাত্রীর বাড়ি থেকে মসজিদের কাছে পাত্রীর বয়সের প্রমাণপত্র সঙ্গে আনতে হবে। সেখানে যদি দেখা যায় মেয়েটির বয়স আঠারো পেরিয়েছে, তবেই মসজিদ কমিটির পক্ষ থকে বিয়ে পড়ানোর জন্য ইমামকে সংশ্লিষ্ট বিয়েতে পাঠানো হবে। এবং কাবিলনামায় নাম উঠবে।
মসজিদ কমিটির এক সদস্য জানাচ্ছেন, ‘‘প্রথম থেকেই এই নিয়ম চালু করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। নানা সমস্যা ও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু কমিটি পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তাতে কোনও নড়চড় না করায় বর্তমানে এই উদ্যোগ সফল হয়েছে।’’
মসজিদ কমিটির এই সিদ্ধান্তে খুশি অনেকেই। বিশেষত, সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি ও নবীন প্রজন্মের লোকজন এই সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। স্থানীয় এক যুবক রাজিবুল শেখ যেমন বলছেন, ‘‘শোনার পর থেকেই খুব ভাল লাগছে। তবে শুধু কমিটির পক্ষ থেকে নিয়ম করলেই হবে না। এই বিষয়ে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’’
কালীগঞ্জের ব্লকের আর এক বাসিন্দা জেসমিন হোসেন বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ সমর্থন করছি। শুধু মাত্র নতুন পাড়ার মধ্যেই এই নিয়মে আটকে না থেকে সব জায়গায় এটা চালু হওয়া উচিত।’’ তাঁর দাবি, আঠারো বছর বয়স পেরিয়ে গেলেও অনেক মেয়ে বিয়ে না করে পড়তে চান, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। সে দিকেও নজর দেওয়া উচিত।
নতুন পাড়া মসজিদ কমিটির সম্পাদক মনিরুল হক বলছেন, ‘‘আঠারো বছরের আগে মেয়ের বিয়ে আইনত অপরাধ, তা ভারতের আইনে লেখা আছে। দেশের নাগরিক হয়ে তা অমান্য করি কী করে!’’ তিনি জানিয়েছেন নাবালিকা বিয়ের কুফল নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এবং সব দিক ভাবনাচিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর মসজিদের ইমাম নুর হামিদ শেখ বলছেন, ‘‘মুসলিমদের মধ্যে অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। তাই আমরা নিয়ম করে বাল্যবিবাহ রোধের চেষ্টা করছি।’’ তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, নাবালিকার বিয়ে দেবেন না।
স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে। এক পুলিশকর্মী বলছেন— ‘‘আমরা তো নাবালিকা বিয়ের খবর পেলেই আইনত ব্যবস্থা নিই। তবে এই ভাবে গ্রামে গ্রামে মানুষ এগিয়ে এলে আর প্রথাটাই এক দিন থাকবে না।’’