প্রায় সওয়া-শো বছরের প্রাচীন এক নাটমন্দির। মাঝ বরাবর গর্ভগৃহে রাধা মদনমোহনের সুপ্রাচীন বিগ্রহ। একটু দূরে নাটমন্দিরের নকশাদার মেঝে যেখানে মিশেছে জগমোহনে, সেইখানে রয়েছে ছবিটা। নাটমন্দিরের সাদা উত্তরীয় দিয়ে ঢাকা চেয়ারে ফুলের মালা, ধূপ, চন্দনে সাজানো কাজী নজরুল ইসলাম। রাধা মদনমোহন প্রণাম করতে গেলেই চোখ পড়বে কবির দিকে।
১১ জ্যৈষ্ঠ, তাঁর জন্মদিনে এ ভাবেই নজরুলকে শ্রদ্ধা জানানো হল নবদ্বীপের মদনমোহন মন্দিরে। কিন্তু বৈষ্ণবমন্দিরে নজরুলকে কেন শ্রদ্ধা জানানো? উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে অনেকগুলো দশক। সেটা ১৯৩৭ বা ১৯৩৮ সাল। নবদ্বীপের মদনমোহনের ওই একই নাটমন্দির সে দিন এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখেছিল। মেঝেয় পাতা ফরাসে বসে হারমোনিয়ম নিয়ে সুর খোলা গলায় সুর তুলেছেন নজরুল— ‘দুর্গমগিরি কান্তর মরু দুস্তর পারাবার।’ আর মনোযোগী ছাত্রের মতো সে গান গলায় তুলে নিচ্ছেন এক গোস্বামী সন্তান! বৈষ্ণবমন্দিরে বিধর্মী নজরুলের এ হেন উপস্থিতি সে সময়ে আলোড়ন তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মদনমোহন মন্দিরের সেবায়েত গোস্বামী পরিবার চিরকালই উদার মনোভাবাপন্ন। সে দিনের সেই গোস্বামী সন্তানও ছিলেন অত্যন্ত সমৃদ্ধ এক সঙ্গীত পরম্পরার সুযোগ্য উত্তরসূরী রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী। তাঁর সঙ্গীতগুরু ছিলেন সঙ্গীতাচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। পিতামহ ছিলেন বাংলা কীর্তনের নতুনধারা গৌরলীলার প্রবর্তক প্রাণগোপাল গোস্বামী। পিতা যদুগোপাল ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রসিদ্ধ শিল্পী ভগবান সেতারীয়ার ছাত্র। তবলার তালিম নিয়েছিলেন সতীশ বাগচীর কাছে।
“সঙ্গীতচর্চার সূত্রেই আমাদের পূর্বপুরুষ রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী ওরফে রাধনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় নজরুলের। ভীষ্মদেবের প্রিয়শিষ্য ভুলু সেন এবং রাধাকৃষ্ণ ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। ভুলু সেনের মাধ্যমেই নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তী কালে একাধিক বার উনি নবদ্বীপে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। তাঁকে নিয়ে অনেক ঘটনা আমাদের পারিবারিক মহলে প্রচলিত আছে,”— বলছিলেন মদনমোহন মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত এবং রাধাকৃষ্ণ গোস্বামীর ভাইপো নিত্যগোপাল গোস্বামী। চৈতন্যসখা নিত্যানন্দের বংশধর ওই গোস্বামী পরিবারের অন্যতম খ্যাতকীর্তি পুরুষ প্রাণগোপাল গোস্বামী ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপের গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে গড়ে বর্তমান মন্দির গড়ে তোলেন।
নিত্যগোপাল বলেন, “আমাদের এই মন্দিরে সে কালের অনেক বিশিষ্ট মানুষই এসেছেন। যাঁদের মধ্যে কাজী নজরুল অন্যতম। সে কালে বাড়ির বহির্ভাগে দোতলায় ছিল অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা। শুনেছি, নজরুল সেই ঘরে থাকতেন। তাঁর ব্যবহার করা চেয়ারটি এখনও আমাদের অন্যতম সম্পদ।” এর পর নবদ্বীপের গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। শহরের ৩৯, ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডের মদনমোহন মন্দিরের খোলনলচে আমূল বদল হয়েছে। কিন্তু কাজী সাহেবের স্মৃতি বিজড়িত সেই মেহগনি কাঠের চেয়ার এখনও সযত্নে রক্ষিত। নজরুলের রাত কাটানো সেই ঘরটি এখনও প্রায় একই রকম রেখে দিয়েছেন। আর এক সেবায়েত প্রেমগোপাল বলেন, “নজরুলকে নিয়ে নানা গল্প শুনেছি আমার পিতৃদেব মদনগোপাল গোস্বামীর কাছে। তখন তিনিও ছোট। প্রাণগোপাল গোস্বামীর বালবিধবা বউদি রাধারানি দেবী, যিনি বড়মা নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি নিজে হাতে নজরুলকে খাওয়াতেন।”
নদিয়ার সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক বরাবরই ঘনিষ্ঠ ছিল। ১৯২৬ থেকে ১৯২৮ কৃষ্ণনগরে কাটান কবি। তার পরেও যোগাযোগ একেবারে ছিন্ন হয়নি। তিনের দশকে তিনি যখন মাঝেমধ্যেই নবদ্বীপে আসতেন, তখন ১৯৩৭ সালে তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত ভক্তিগীতি রেকর্ড হয়েছিল— “বর্ণচোরা ঠাকুর এলো রসের নদিয়ায়, তোরা দেখবি যদি আয়।” নাটমন্দিরে এবারের জ্যৈষ্ঠ সকালে শোনা গেল সেই গান। নিজস্ব চিত্র