সিপিএমের দেওয়াল লিখনে কটাক্ষ মোদী ও মমতাকে। ছবি: প্রণব দেবনাথ
বিজেপির দেওয়ালে উঠে এসেছে বর্ণপরিচয়। ‘গেরুয়া ঝড় আসছে তেড়ে, ভাগ তৃণমূল বাংলা ছেড়ে।’ কিংবা ‘অ–এ অনুব্রত আসছে তেড়ে। আ–এ আরাবুল জমি নিচ্ছে কেড়ে। ই–এ ইমামভাতায় ভোটটি বাড়ে। ঈ মুবারক হিজাব পড়ে।’ এ ভাবে স্বরবর্ণ জুড়ে প্রচারের অভিনব ছড়া অনেকের নজর কেড়েছে।
অন্য দিকে, শাসকদলের দেওয়ালে কাজের খতিয়ান। ‘তৃণমূল মানে পেট ভরে ভাত, খাদ্যসাথীর আহ্বান। তৃণমূল মানে সবুজসাথীতে কন্যাশ্রীর জয়গান।’
তবে এমন ছড়া আদৌ মনে ধরে না পঞ্চাশ বছর ধরে দেওয়াল লেখা একদা কট্টর বামপন্থী শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর। ভোট এলেই মনে পড়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লাইন ‘লাগ লাগ করে লেগে যায়, এর ঢাল ওর তরোয়াল, ভোট কুড়ুনিরা কেড়ে নেয় ঘুঁটে কুড়ুনির দেওয়াল।’
সে সময়টাই ছিল অন্য রকম। ভোট প্রচারে দেওয়ালই তখন প্রধান মাধ্যম। দিন ঘোষণা হওয়া মাত্র সব দলের কর্মীরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেওয়াল চুনকাম করতেন। তিনি বলেন “এমনকি রাত জেগে সিপিএমের মোমবাতির আলোয় কংগ্রেস, কংগ্রেসের হ্যারিক্যানের আলোয় সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা দেওয়াল-যুদ্ধে মাতত। একটা চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিত সকলে। এখনকার মতো আমরা-ওরা ছিল না। প্রচুর মজাও হত দেওয়াল লেখা নিয়ে।” স্মৃতি হাতড়ে প্রবীণ মানুষটি তুলে আনেন না ভোটের ছড়া। সত্তরের ভোটে কংগ্রেস দেওয়ালে লিখল, ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, কদমতলায় কে? প্রমোদ নাচে, কেষ্ট নাচে জ্যোতি বসুর বে!’ বামেদের জবাবি ছড়া— ‘ঠিক বলেছিল, ঠিক বলেছিস, ঠিক বলেছিস ভাই। ভোটের দিন ইন্দিরাকে সাজিয়ে আনা চাই!’
কংগ্রেস-সিপিআই জোট নিয়ে একটা ছড়া মুখে মুখে ঘুরত, ‘দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’ জোটের জমানায় কংগ্রেস একবার লিখেছিল, ‘একটি গরুর দু’টি শিং, জ্যোতি বসু, ভিপি সিং!’ বাজপেয়ির আমলে নির্বাচনে বামদের দেওয়ালে দেখা যেত ‘বিষবৃক্ষের দু’টি ফুল, বিজেপি-তৃণমূল!’ পাল্টা দিয়েছিল তৃণমূল, ‘বিষবৃক্ষে ফুল হয় না, মূর্খ সিপিএম তাও জানে না।’
তেমন বুদ্ধিদীপ্ত ছড়া যে লেখা হয় না, তা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন। বেশির ভাগ ছড়াই যেন স্লোগানের মতো। নিতান্ত সাদামাঠা প্রচারসর্বস্ব। এসব ছড়ায় বুদ্ধিমত্তার ছাপ তেমন চোখে পড়ে না। অন্তমিল পঙ্ক্তিকে ছড়া বলতেই রাজি ছড়াকার ও কবি সিরাজুল ইসলাম। তাঁর কথায়, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোট প্রচারে দেওয়াল পদ্য বা ছড়ার গুরুত্ব ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।’’
তবু হঠাৎই কোনও দেওয়ালে চোখ আটকে যায়। দেওয়াল জোড়া অক্ষরবৃত্তে সলিল চৌধুরীর ছোঁয়া। ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’র ঢঙে লেখা হয়েছে, “হাটে সততার হাঁড়ি ফাটছে, আজ জনগণ সব জানছে, যত বিশ্বাসগুলো ভাঙছে, পথে মানুষের ঢল নামছে, সব কণ্ঠে আওয়াজ উঠছে, এই আঁধারের রাত কাটছে। ওই আসছে, সে দিন আসছে।”