আতঙ্ক তখনও কাটেনি। নিজেদের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন সেই ট্রেনের যাত্রীরা। সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
ভোর রাতে আপ কৃষ্ণনগরগামী লোকালে বিস্ফোরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—লোকাল ট্রেনে সাধারণ যাত্রীদের নিরাপত্তা কতটা শিথিল!
সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, মাঝে মাঝে আরপিএফ ট্রেনে তল্লাশি চালায় বটে। তা যথেষ্ট নয় মঙ্গলবারের ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে। তল্লাশি চালানোর আধুনিক পরিকাঠামোও রেল পুলিশের নেই। কৃষ্ণনগর স্টেশনে সবেধন নীলমণি একটা মেটাল ডিটেক্টর যদিও। সেটাও নিয়ে গিয়েছে শিয়ালদহের বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড। তাই কে, কখন, কী নিয়ে ট্রেনে উঠছেন তা বোঝার কোনও উপায় নেই রেল পুলিশের নেই। শুধু ‘অভিজ্ঞ চোখ’ ও যাত্রীদের আচরণ—মূলত দুই অভিজ্ঞতায় যাত্রী নিরাপত্তার দিকটা সামলাচ্ছেন কৃষ্ণনগর জিআরপি থানার পুলিশকর্মীরা।
পলাশি থেকে বীরনগর—কৃষ্ণনগর জিআরপি থানার অধীনে ১৩টি স্টেশন রয়েছে। জিআরপি থানা সূত্রে খবর, ১৯৯৩ সালের নির্দেশিকা অনুযায়ী দু’জন এসআই ও তিন জন এএসআই-সহ ৩৬ জন কনস্টেবল থাকার কথা। কিন্তু পুলিশকর্মী রয়েছেন ৩৩ জন। এই ক’বছরে ট্রেন ও যাত্রীর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়লেও পুলিশকর্মীর সংখ্যা সে ভাবে বেড়েছে কই। এই মুহূর্তে কৃষ্ণনগর স্টেশন দিয়ে দিনে ৩৬টি ট্রেন চলাচল করে। গড়ে প্রায় ৩০ হাজার যাত্রী অসংরক্ষিত টিকিট কাটেন। কিন্তু এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে প্রতিটি কামরায় অন্তত একজন পুলিশ থাকা উচিত। ট্রেনের এক প্রান্তে কোনও ঘটনা ঘটলে অন্য প্রান্তে থাকা পুলিশকর্মী টের পান না। কোনও ঘটনা ঘটে গেলে তাঁর দায় কতটা?’’ তাঁর অভিজ্ঞাতা, সন্ধ্যার পরে প্রতিটি স্টেশনেই পুলিশকর্মী থাকা উচিত। কিন্তু পর্যাপ্ত কর্মীর অভাবে সেটা সম্ভব হয় না। এক দিকে কম পুলিশকর্মী অন্য দিকে, তল্লাশি চালাতে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব—এই দু’য়ের সুযোগে বোমা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে ট্রেনের কামরায় পা দিতে পিছপা হচ্ছে না দুষ্কৃতীরা।
কৃষ্ণনগর স্টেশনে রেল পুলিশের তল্লাশি। সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
এ দিন কৃষ্ণনগর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল তখনও আতঙ্ক কাটেনি অনেক যাত্রীর। তাঁদেরই একজন সন্দীপ গঙ্গোপাধ্যায়। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে আসছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘যেখানে বিস্ফোরণ হয়, ঠিক তার পাশের কামরায় ছিলাম। টিটাগড়ের স্টেশনের কাচে বিকট আওয়াজ শুনি। দেখি চারদিক ধোঁয়ায় ভরেছে। স্টেন ব্যারাকপুরে ঢুকতেই ট্রেন থেকে নেমে পড়ি।’’ সকালের দিকের আপ ট্রেনে যাত্রী কম থাকেন। সেই সুযোগে ট্রেনেই নানা অসামাজিক কাজ হয় বলে অভিযোগ। যাত্রীদের অনেকেরই মত, ভেন্ডর কামরা সবথেকে বিপজ্জনক হয়।
এ সব ঠেকাতে মাঝে মধ্যেই আরপিএফকে সঙ্গে নিয়ে তল্লাশি চালায় জিআরপি। প্রয়োজনে যাত্রীদের ব্যাগ খুলেও দেখা হয়। কিন্তু তখন যদি সন্দেহজনক কিছু মেলে?
টিটাগড়ে বিস্ফোরণের পরে বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে তৎপর পুলিশ। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
কর্তব্যরত এক রেল পুলিশের কর্তা বলেন, ‘‘তেমন মনে হলে শিয়ালদহের বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডকে খবর দেওয়া হয়। তারা এসে যা করার করে। ততক্ষণ আমাদের দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না।’’ অনেকেই বলছেন, প্রতিটি থানায় অন্তত এক জন করে বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের কর্মী রাখা জরুরি। তা না হলেও অন্তত দু’এক জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। ওয়েস্ট বেঙ্গল প্যাসেঞ্জারস অ্যাসোসিশনের সাধারণ সম্পাদক পুণ্ডরীকাক্ষ কীর্ত্তনীয়া বলেন, ‘‘আমরা একাধিকবার রেলের যাত্রী পরিষেবা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। এই ঘটনায় প্রমাণ হল আমাদের দাবি কতটা সঙ্গত। রেলের উচিত যাত্রীদের নিরাপত্তার দিকটি আরও বেশি করে গুরুত্ত্ব দেওয়া।’’ এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি কৃষ্ণনগর জিআরপি থানার ওসি কৃষ্ণগোপাল মালাকার।