দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ির প্রবেশপথ।
কৃষ্ণনগরকে তিনি বলতেন ‘যৌবনের উপবন’। যদিও কবি, নাট্যকার, গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সম্পর্কে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি আশ্চর্য উদাসীন চিরকাল। একশো সাতান্নতম জন্মদিনেও কৃষ্ণনগরে সেই শীতলতার তেমন কোনও পরিবর্তন ঘটছে না।
জন্মদিনের আগের বিকেলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মভিটের যে অংশটুকু টিকে আছে তার সামনে ধূসর স্মৃতিফলক কিংবা জেলা সদরের ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে মলিন দ্বিজেন্দ্রমূর্তির গলায় থাকা কবেকার শুকনো মালা বলে দেয়— নিজ ভূমে উপেক্ষার ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে!
দ্বিজেন্দ্রলালকে নিয়ে কৃষ্ণনগরের শীতলতার শুরু হয়েছিল সেই ১৮৮৬ সালে। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে পড়াশুনো শেষ করে লন্ডন থেকে দেশে ফিরলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। কিন্তু বিলেত ফেরত দ্বিজেন্দ্রলালকে গ্রহণ করল না তাঁর ‘জীবনের ধাত্রী’ ‘শৈশবের দোলা’ প্রিয় কৃষ্ণনগর। জাহাজ থেকে নেমে কলকাতায় বসেই তিনি শোনেন হিন্দু সমাজপতিরা নির্দেশ দিয়েছেন কালাপানি পার হওয়া দ্বিজেন্দ্রলালকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তিনি তাতে রাজি হননি। ফলে, কৃষ্ণনগরে ফিরে তিনি দেখলেন পৈত্রিক বাড়িতে নয় দাদারা তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছেন অন্য এক বাড়িতে।
তাঁকে একঘরে করা হয়েছে। এই ধাক্কা সামলাতে পারেননি কবি। তিনিও অভিমানে এই শহর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। জীবনের অন্তিম পর্বে, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে শেষ বার তাঁর ‘আত্মার উপবন’ কৃষ্ণনগরে এসে ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। কিন্ত বেশি দিন থাকতে পারেননি।
দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের বসত ভিটার সবই অবলুপ্ত। প্রবেশ তোরণের দু’টি স্তম্ভ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। আর আছে তাঁর নামাঙ্কিত সেতু, সড়ক, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু মূর্তি। কবির বসতবাড়ির অংশে পরে স্থাপিত হয়েছে দ্বিজেন্দ্র পাঠাগার। আছে দ্বিজেন্দ্র স্মৃতি রক্ষা কমিটি। জন্মদিনে দ্বিজেন্দ্রলালকে ঘিরে দু’টি সংস্থার তরফে কিছু অনুষ্ঠান, আলোচনা, পুরস্কার প্রদানের মধ্যে দিয়েই দ্বিজেন্দ্রলালকে ছুঁতে চায় কৃষ্ণনগর।
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১৯ জুলাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মদিন হলেও অন্য বছরের মতো এ বারও বাংলা সনের হিসেবে ৪ শ্রাবণ তাঁর জন্মদিনে পালন করা হবে। ১৯৯৯ সাল থেকে দ্বিজেন্দ্র পুরস্কার প্রদান করে আসছেন সরকারের দ্বিজেন্দ্র পাঠাগার কর্তৃপক্ষ। এ বার দ্বিজেন্দ্র পুরস্কারের প্রাপক কবি অভিমন্যু মাহাতো। অন্য দিকে দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতি এবং কৃষ্ণনগর সাংস্কৃতিক মঞ্চের আয়োজনে দ্বিজেন্দ্রলালকে নিয়ে তিন দিনের নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে।
এই মরসুমি অনুষ্ঠান ছাড়া বছরের বাকি সময়ে খোদ কৃষ্ণনগরে কি দ্বিজেন্দ্র-চর্চা আদৌ কিছু হয়? বর্তমান প্রজন্মের সামনে দ্বিজেন্দ্রলালকে তুলে ধরার জন্য ধারাবাহিক কোনও কার্যক্রম? তাঁর গান, নাটক নিয়ে কোনও বিশেষ ভাবনা?
দ্বিজেন্দ্র-চর্চার অনুসন্ধানে মিলেছে কেবল ক্ষোভ আর নেতিবাচক জবাব। যেমন, দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতির সম্পাদক বাসুদেব মণ্ডল জানাচ্ছেন, ২০১৩ সালে কবির দেড়শো বছরে রাজ্য সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দফতর এবং কৃষ্ণনগর দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতির যৌথ উদ্যোগে মধুসূদন মঞ্চে শুরু হয়েছিল কবির জন্মদিন উদ্যাপন। মাত্র দুই বছরের মাথায় সে উদ্যোগ থেকে সরেছে রাজ্য সরকার।
বাসুদেব বলছেন, “২০১৭ সাল পর্যন্ত আমরা কখনও শিশির মঞ্চে, কখনও ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ মঞ্চে দ্বিজেন্দ্র জন্মোৎসব পালন করেছি। কিন্তু নিজেদের ক্ষমতায় কলকাতায় গিয়ে উদ্যাপন বেশি দিন সামর্থ্যে কুলায়নি। তাই এখন কৃষ্ণনগরেই করা হয়।” তিনি জানান, কৃষ্ণনগরে শুরু হয়েছিল দ্বিজেন্দ্র নাট্য প্রতিযোগিতা। প্রথম বার ছ’টি দল, দ্বিতীয় বার দু’টি দল। তবে তার পরের বার থেকে দলের অভাবে তা বন্ধ করে দিতে হয়।
কবির বাসভবনে দ্বিজেন্দ্র পাঠাগার কর্তৃপক্ষ এ দিন দ্বিজেন্দ্র পুরস্কার প্রদান করেন। দিনভর উৎসব হয়। এর বাইরে দ্বিজেন্দ্র-চর্চা প্রসঙ্গে পাঠাগারের সম্পাদক স্বপন মৈত্র বলছেন, “কবির নামে গ্রন্থাগারে প্রচুর বই রয়েছে। উৎসাহীরা আসেন পড়াশোনা করেন।”
ব্যস ওইটুকুই। উল্টে দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতি বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তিনি, “ওই সমিতি কী ভাবে কাজ করে, জানি না। তবে সমিতির ঘর সারা বছর বন্ধ থাকে। দ্বিজেন্দ্রলালের ভিটার যেটুকু অংশ আছে, তার প্রাচীর ভেঙে পড়েছে। সংস্কার করার কেউ নেই।” এ দিকে, দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতি জানাচ্ছে সরকারি সহায়তা ছাড়া শুধু মাত্র বেসরকারি উদ্যোগে দ্বিজেন্দ্র সাম্রাজ্য সামলানো অসম্ভব। এত কিছু নেইয়ের মাঝে প্রাপ্তি বলতে দ্বিজেন্দ্র স্মৃতিরক্ষা সমিতির প্রকাশিত দ্বিজেন্দ্র স্মারক গ্রন্থ—আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কার।