কিরীটেশ্বরী মন্দির। —নিজস্ব চিত্র।
নিম্নচাপের বৃষ্টির পর শীত ছুঁয়েছে বাংলাকে। দেরিতে হলেও মোটামুটি ঠান্ডার আমেজ জেলায় জেলায়। বেড়ানোর এই তো সময়। পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে তাই সেজে উঠছে ভাগীরথীর পশ্চিম কূলের জঙ্গলাকীর্ণ নানা মন্দির অধ্যুষিত গ্রাম কিরীটকণা বা কিরীটেশ্বরী। ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের তরফে ‘বেস্ট ট্যুরিজ়ম ভিলেজ অফ ইন্ডিয়া’ খেতাব পাওয়া সেই গ্রামে খরচ হচ্ছে কোটি টাকারও বেশি। দেশের ‘সেরা গ্রাম’ দেখার জন্য যে পর্যটকেরা আসবেন, তাঁদের জন্য এ বার রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে অডিটোরিয়াম এবং মুক্ত মঞ্চ। চলতি শীতের মরসুমে লাভের আশায় স্থানীয় ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা।
দেশের ৭৯৫টি আবেদনের মধ্য থেকে ভারত সেরার শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছে মুর্শিদাবাদের প্রান্তিক গ্রাম কিরীটেশ্বরী। সেই গ্রামকে আরও ভাল করে চেনাতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, কিরীটেশ্বরীর উন্নতিকল্পে রাজ্য পর্যটন দফতর ইতিমধ্যে ১৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে। পাশপাশি জঙ্গিপুর লোকসভার সংসদ খলিলুর রহমানের সংসদ তহবিল থেকে বরাদ্দ হয়েছে ৭০ লক্ষ টাকা। আর স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বরাদ্দ হয়েছে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা। সব মিলিয়ে কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ অর্থে ঢেলে সাজানো হচ্ছে মন্দিরের গ্রাম। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সর্বতো ভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক শৌচালয়, বহিরাগত পর্যটকদের জন্য রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত হচ্ছে। এলইডি আলোয় আলোকিত হবে গোটা মন্দির চত্বর।’’
শুধু তাই নয়। বিভিন্ন সংস্থার অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হচ্ছে মুক্তমঞ্চ। আগামী বছরের প্রথম মাসের মধ্যেই এই সব কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্থায়ী নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে জায়গা চিহ্নিত করার কাজ শেষ হয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দরপত্র বণ্টনের প্রক্রিয়াও হয়ে গিয়েছে।
জানা গিয়েছে, বাংলার পৌষ মাস জুড়ে মেলা হবে কিরীটেশ্বরীতে। সেই উৎসব পর্ব মিটলে জোরকদমে শুরু হয়ে যাবে বাকি কাজ। এ নিয়ে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র বলেন, ‘‘বেশ কিছু প্রকল্পের জন্য জমি চিহ্নিতকরণ হয়ে গিয়েছে। পৌষমেলা শেষ হলেই জোরকদমে কাজ শুরু হয়ে যাবে।’’
রাজ্যের এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে মন্দির কমিটির সহ-সম্পাদক সৌমিত্র দাসের কথায়, ‘‘স্থানীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন এবং রাজ্য পর্যটন দফতর যে ভাবে কিরীটেশ্বরী মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে অচিরেই পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে এই জায়গা।’’
কিরীটেশ্বরীর পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ মনে করায় গৌরবের স্মৃতিকথা। ধর্মীয় বিশ্বাস, দক্ষযজ্ঞে সতীর কিরীট (মুকুট) পতিত হয়েছিল এই স্থানে। তাই এই গ্রাম শাক্ত সাধনার অন্যতম স্থল। প্রতিষ্ঠিত দেবী কিরীটেশ্বরী হিসেবে সমাদৃত। বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান ডহপাড়ার কয়েক কিলোমিটার দূরে কিরীটকণা গ্রামের অবস্থান। লোকমুখে যার পরিচিতি কিরীটেশ্বরী গ্রাম নামেই। আর একটি ব্যাপার হল, এই গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাসিন্দাদের সাহচর্যে রক্ষিত হচ্ছে হিন্দু ধর্মের এই শক্তিপীঠ। এর পরিচালন কমিটিতেও রয়েছেন একাধিক মুসলিম সদস্য। আর সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গ্রামের মুকুটে এসেছে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা।
সেই জায়গা ক্রমশ উন্নত হচ্ছে, পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে দেখে খুশি স্থানীয়রা। বিশেষত ব্যবসায়ীরা। পর্যটন ব্যবসায়ী রক্তিম বিশ্বাসের কথায়, ‘‘এখনই কলকাতা থেকে পর্যটকদের ফোন পাচ্ছি। প্রত্যেকের একটাই প্রশ্ন, মন্দির চত্বরে থাকার কোনও ব্যবস্থা রয়েছে কি না। সবাই মন্দির চত্বরে রাত্রি কাটাতে উৎসাহী।’’ জোর দিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কিরীটেশ্বরী পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হবে।’’ আর তৃণমূল সাংসদ খলিলুর বলেন, ‘‘পরিকাঠামো ঢেলে সাজাতে ৭০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছি। প্রয়োজনে আরও বরাদ্দের চেষ্টা করব। পর্যটকদের কাছে অনুরোধ, আপনারা কিরীটেশ্বরী আসুন।’’