বর্ষার দুপুরের মেনু। কৃষ্ণনগরের এক রেস্তোরাঁয়। — নিজস্ব চিত্র।
রাত থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি। জল থইথই চারদিক। কর্তার অফিস-কাছারি শিকেয়। খুদেদের নির্ভেজাল ‘রেনি ডে’। এমন নাছোড় বৃষ্টির দিনে গিন্নিকে ‘কই গো চালে-ডালে একটু বসিয়ে দেবে নাকি’ বলে আরও এককাপ চা শেষ করে কর্তা বেরিয়ে পড়বেন বাজারের থলি হাতে। সাধ থাকলেও হাজার টাকার ইলিশ যদি সাধ্যে না কুলোয় তবে বর্ষার দুপুরে গরমাগরম খিচুড়ির সঙ্গে ডিমের ওমলেটই সই। আমিষ না চললে ডিমের বদলে মুচমুচে পাঁপড় কিংবা বেগুন ভাজা। শেষপাতে একটু চাটনি। বর্ষার এই মেনুর কাছে মাংস-পোলাও-বিরিয়ানিও বলে বলে গোল খাবে।
এমন বাদল দিনে বাঙালি হেঁসেলের একমাত্র ‘সিগনেচার টিউন’ খিচুড়ি এখন হোটেল-রেস্তোরাঁতেও জনপ্রিয় পদ। বৃষ্টির দিনে কৃষ্ণনগরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক লাগোয়া ‘হাভেলিতে’ গেলেই মিলবে খিচুড়ি, মাছের ডিমের বড়া, শুকনো আলুর দম, আমের চাটনি, পাঁপড় ও রসগোল্লা। শেষে একখিলি পান। সবমিলিয়ে এই ‘ডিশ’ মিলছে মাত্র ৮০ টাকাতে। ওই রেস্তোরাঁর মালিক সঞ্জীব চাকি জানান, সুগন্ধী গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগ ডালের খিচুড়িতে ঘি-গরমমশলা দিয়ে বিশেষ ভাবে রান্না করা হয় এই খিচুড়ি। শুকনো আলুর দম, পাঁপর ভাজা রাখা হয় নিরামিষাসিদের কথা মাথায় রেখে।
কিন্তু খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ কই? সঞ্জীববাবু বলেন, “বাজারে ইলিশের যা দাম, তাতে ওই মেনুতে ইলিশ পড়লে সেটা আর সাধারণের নাগালে থাকবে না। তাই আমরা বিকল্প হিসেবে মাছের ডিমের বড়া রেখেছি। স্পেশ্যাল রেসিপির ওই বড়া কিন্তু বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।” তাঁর সোজা হিসেব, কেজি খানেকের একটা ইলিশ থেকে বড়জোর পাঁচ পিস মাছ পাওয়া যাবে যা খরিদ্দারের পাতে ভেজে পরিবেশন করা যায়। ওই ওজনের ইলিশের চলতি মরসুমে দর কেজি প্রতি হাজার টাকার আশপাশে। যার অর্থ এক পিস ইলিশ মাছ ভাজার দাম পড়বে ২০০ টাকারও বেশি। এই দামে খিচুড়ি-ইলিশ বিকোবে না।
কিন্তু একটা সময় ছিল যখন ইলিশ ছাড়া বর্ষার খিচুড়ি ভাবাই যেত না। এলাকার বাজারে বর্ষায় নিয়মিত ইলিশও মিলত। সেই সস্তার বাজারে ইলিশের দামও ছিল সাধারণের নাগালে। কৃষ্ণনগরের বহু প্রবীণদের আজও মনে আছে সেই ইলিশ-খিচুড়ির কথা। সময়টা ১৯৬০ কি ১৯৬১ সাল হবে। বর্ষাকাল। এমন এক বৃষ্টিভেজা দিনে কৃষ্ণনগরে সে কালের আবাসিক হোটেল বাসশ্রীর রান্নাঘরে হঠাৎই ব্যস্ততা চরমে উঠল। সাতসকালে নাকি দোতলার কোণের ঘরের বোর্ডার বাবুটি হোটেল মালিকের কাছে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার আবদার করেছেন। ওই বাবু মাঝেমধ্যেই এই হোটেলে এলেই কেমন যেন উৎসব লেগে যেত। মালিক হরেন্দ্রনাথ সাহার কড়া হুকুম ‘ওঁর যেন কোন অযত্ন না হয়। উনি অনেক বড় মাপের মানুষ।’’ মালিকের হুকুম অমান্য করে সাধ্য কার! অতএব খিচুড়ি-ইলিশের প্রস্তুতিতে সাজ সাজ রব। ষাটের দশকে বাসশ্রী-র দোতলার কোণের ঘরের সেই বোর্ডারের নাম মণীশ ঘটক। মূলত লেখালেখির জন্যই সে সময় ওই হোটেলে নিয়মিত আসতেন তিনি। হোটেলের এই প্রজন্মের মালিক হিমাদ্রি সাহা বলছেন, ‘‘বাবার সঙ্গে মনীশ ঘটকের অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মহাশ্বেতাদেবীও এখানে এসে থেকেছেন একাধিক বার।”
এরপর জলঙ্গি দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। সেই আবাসিক হোটেল এখন ইতিহাস। বাসশ্রী এখন শুধুই খাওয়ার হোটেল। হিমাদ্রিবাবু বলেন, “এখন আর আমরা খিচুড়ি করি না। সেই সময়ে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষকেরা বোর্ডার হিসাবে থাকতেন আমাদের হোটেলে। শুনেছি, তাঁদের চাহিদা মতোই মেনু করতেন বাবা। বর্ষাকালে খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা তখন নিয়মিত হতো।”
সদ্য প্রয়াত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী শিবু সেন নবদ্বীপে তাঁর রেস্তোরাঁয় আটের দশকে খিচুড়ির প্লেট চালু করে চমকে দিয়ে ছিলেন সবাইকে। নিরামিষ সেই খিচুড়ি প্লেট হিসেবে বিক্রি হতো। তবে সেটা বর্ষায় নয় শীতের রাতে। নিতান্ত ঘরোয়া খিচুড়িকে রেস্তোরাঁয় খাদ্য তালিকায় জায়গা দেওয়ার সাহস দেখিয়ে সেই সময়ে সফলও হয়েছিলেন শিবু সেন।