কৃষ্ণনগর-কাণ্ডে মৃতার প্রেমিক। —ফাইল চিত্র।
কৃষ্ণনগরে তরুণীর মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে ঘটনার সময়ের ৬০ মিনিট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে পুলিশ। যে স্থান থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীর আধপোড়া দেহ উদ্ধার হয়েছিল, শনিবার সেই জায়গা পরিদর্শনে যান ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা। তদন্তের পরিভাষায় যা ‘প্লেস অফ অকারেন্স ভিজিট’। প্রাথমিক ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ‘অ্যান্টিমর্টেম বার্ন ইনজুরি’ (মৃত্যুর আগে অগ্নিদগ্ধ হওয়া) উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক। তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, ময়নাতদন্ত রিপোর্টের সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে তবেই এমন পরিদর্শনের প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া নানা জনকে জিজ্ঞাসাবাদ, মৃতার পরিবারের বয়ান, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এবং এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পাওয়া তথ্য ‘চেন অফ অকারেন্স’ (ঘটনা পরম্পরা) মিলিয়ে দেখতে গিয়ে কিছু জায়গায় খটকা লাগছে তদন্তকারীদের। পুলিশের একটি সূত্রে খবর, ঘটনার দিন রাত ১০টা ১২ থেকে ১১টা ১২ মিনিট পর্যন্ত সময়ে ঠিক কী কী ঘটেছিল, সেটা জানা গেলেই তদন্তপ্রক্রিয়া অনেকাংশে সহজ হয়ে যাবে।
তদন্তকারী সূত্রে দাবি, ঘটনাস্থলে কেরোসিন জাতীয় তরল দাহ্য রাখার বোতল এবং দেশলাই পাওয়া গিয়েছে। মৃতার দেহেও পোড়ার চিহ্ন মিলেছে। কিন্তু জীবিত অবস্থায় অগ্নিসংযোগ হলে বাঁচার জন্য আর্তনাদ এবং ছটফটানির নমুনা ঘটনাস্থলে পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া, হোয়াট্সঅ্যাপ স্টেটাসে আত্মহত্যা করছেন বলে যে (ওই স্টেটাসের সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) লাইন লেখা হয়, সেটা কি তরুণী নিজেই লিখেছিলেন, না কি অন্য কারও লেখা?
তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে আরও চারটি প্রশ্ন। এক, কলেজ মাঠে অন্য এক তরুণের সঙ্গে দেখা গিয়েছে তরুণীকে। কিন্তু সেখানে তিনি কী ভাবে গিয়েছিলেন? দুই, মৃতার প্রেমিকের পরিবারের দাবি অনুযায়ী, অভিযুক্ত ঘটনার দিন কৃষ্ণনগর নয়, রানাঘাটে উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন তরুণীর ফোন থেকে একাধিক বার অভিযুক্ত যুবকের (প্রেমিক) মোবাইলে কল করা হয়েছে। সেটা কি সাধারণ কথাবার্তার জন্য, না কি দু’জনের মধ্যে কোনও গন্ডগোল হয়েছিল? তিন, মৃতা এবং ধৃত যুবকের সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় কোনও মানুষের প্রবেশ, না কি ধারের টাকা ফেরত চাওয়া নিয়ে দু’জনের মতানৈক্যের সূত্রপাত ঘটেছিল? চার, অভিযুক্তের দাবি, গত মঙ্গলবার, ঘটনার দিন তরুণীর সঙ্গে দেখা হয়নি তাঁর। তদন্তকারীদের তথ্য বলছে, প্রায় একই এলাকায় দু’জনের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন পাওয়া গিয়েছে। তরুণী এবং তাঁর প্রেমিকের কি আদৌ দেখা হয়েছিল?
পুলিশ সূত্রে খবর, ঘটনার দিন অর্থাৎ গত মঙ্গলবার প্রেমিকা এবং তাঁর এক ‘কমন ফ্রেন্ড’-এর ফোন পেয়ে ১০টা ১২ মিনিটে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন অভিযুক্ত। পরে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ চত্বরে তাঁকে দেখা গিয়েছে। তার প্রমাণ মিলেছে সিসিটিভি ফুটেজে। তরুণীর মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করে দেখা যাচ্ছে, সে দিন রাত ৭টা ৪৫ মিনিট থেকে বেশ কিছু ক্ষণ কলেজ চত্বর থেকে কালেক্টর অফিস হয়ে ডাকবাংলো মোড় পর্যন্ত তিনি গিয়েছিলেন। সেই সময় প্রায় এক ঘণ্টায় বেশ কয়েকটি ‘কল’ গিয়েছে অভিযুক্তের ফোনে। কিন্তু, ধৃত প্রেমিক তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছেন, ওই সময়ে মাত্র এক বারই তাঁদের কথা হয়েছিল। দু’জনের মনোমালিন্য হয়েছিল। ফোনে তাঁকে সম্পর্কছেদের কথা বলেছিলেন প্রেমিকা। ধৃতের মায়ের দাবি অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাত ১১টা ১৫ মিনিট নাগাদ বাড়ি ফিরেছিলেন ছেলে। সিসিটিভি ফুটেজে ওই তথ্যের সত্যতা মিলেছে। কিন্তু বাড়ি থেকে বার হওয়া এবং বাড়ি ফিরে আসার মধ্যে একটি ঘণ্টা অভিযুক্ত কার কার সঙ্গে দেখা করেছেন, প্রেমিকার সঙ্গে আদৌও দেখা হয়েছিল কি না, দেখা হলেও ঠিক কী কথা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে, তার খোঁজে তদন্তকারীরা। তদন্তপ্রক্রিয়া প্রসঙ্গে কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে বলেন, ‘‘অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার দিন অভিযুক্ত এবং ছাত্রীর ফোনের কললিস্ট, টাওয়ার লোকেশন বিস্তারিত ভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এলাকার সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখার কাজ এখনও চলছে। তা ছাড়া, অন্যান্য ব্যক্তির বয়ান মিলিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।’’