শুয়োরে-বেড়ালে হাসপাতালে

শরীর দুর্বল। হাসপাতালের শয্যায় বসে ভাত খাচ্ছিলেন এক রোগী। জানালার পাশ থেকে রোগীর পাতে নজর রাখছিল আরও এক জন। একটু অন্যমনস্ক হতেই পাত থেকে হারিয়ে গিয়েছিল নামমাত্র পোনা মাছের টুকরোটাও।

Advertisement

কৌশিক সাহা ও সুপ্রকাশ মণ্ডল

কান্দি ও কল্যাণী শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৬ ০০:৫৭
Share:

কান্দি মহকুমা হাসপাতাল চত্বরে চরে বেড়াচ্ছে শুয়োর।— নিজস্ব চিত্

শরীর দুর্বল। হাসপাতালের শয্যায় বসে ভাত খাচ্ছিলেন এক রোগী। জানালার পাশ থেকে রোগীর পাতে নজর রাখছিল আরও এক জন। একটু অন্যমনস্ক হতেই পাত থেকে হারিয়ে গিয়েছিল নামমাত্র পোনা মাছের টুকরোটাও।

Advertisement

এটা যদি কল্যাণী জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুপুরবেলা হয়, তাহলে আসুন পড়শি জেলার কান্দি মহকুমা হাসপাতালটা ঘুরে আসি—সাতসকাল। তবে তত সকালও নয়। জানলার পাশে প্রবল জান্তব শব্দে ঘুমটাই ভেঙে গিয়েছিল ডেঙ্গিতে ডুবে থাকা রোগীর। কী আশ্চর্য, গোটা দিন জ্বর গায়ে তাঁর আর ঘুমই আসেনি। ঘুম তাড়ানো সেই বরাহ-নন্দনেরাই কান্দি হাসপাতালে দখলদার।

বেড়াল, কুকুর, শুয়োর, ইঁদুরদের নিয়ে রোগীদের এই ঘরকন্নায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, এই সব হাসপাতালের কর্তৃপক্ষও। নির্বিকার গলায় কান্দি মহকুমা হাসপাতালের সুপার মহেন্দ্র মাণ্ডি বলছেন, ‘‘কী করব বলুন তো? শুয়োর তাড়ানো কি আমার কম্ম!” ততধিক নিস্পৃহ গলায় জেএনএম কলেজ হাসপাতালের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘কুকুর-বেড়াল তাড়ানোর চেষ্টা তো আর কম করা হয়নি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।’’ অতএব, যা ঘটার তাই ঘটছে।

Advertisement

মাছ নিয়ে ছুটছে মার্জার। পিছনে ছুটছেন রোগী। অসুস্থ শরীরকে কোনও মার্জনা না করে জিত হয় বেড়ালেরই। এক লাফে জানালার গ্রিল গলে ওপার। শুধু রোগীদেরই নয়, এই হাসপাতালের বেড়াল-বাহিনী রীতিমতো ঝামেলায় ফেলেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও। হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থেকে শুরু করে আয়া, সিস্টারদের মিলিত লড়াইকেও বহু বার ব্যর্থ করে জয়ী হয়েছে সেই বেড়াল-বাহিনী।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, এক বেড়ালে রক্ষা নেই, দোসর আবার সারমেয়। যখন তখন সেই কুকুরও ঢুকে পড়ছে হাসপাতালে। তাদেরও ‘ভিটে ছাড়া’ করতে না পেরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের দ্বারস্থ হয়েছেন।

পেটের ব্যামো নিয়ে এই হাসপাতালে প্রায়ই ভর্তি হতে হয় কল্যাণী হাউজিং এলাকার পশুপতি হালদারকে। তিনি বলছেন, ‘‘প্রথম প্রথম বেশ কয়েকবার বেড়াল পাত থেকে, মাছ-মাংস নিয়ে পালিয়েছে। তার পর থেকে সতর্ক থাকি। অন্যদেরও সতর্ক থাকতে বলি। কিন্তু ওই ব্যাটারাও তক্কে তক্কে থাকে। একটু আনমনা হলেই চিলের মতো ছোঁ মেরে পাত থেকে মাছ নিয়ে হাওয়া।’’

বেড়ালের আস্তানা যখন কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালে। — নিজস্ব চিত্র

এতদিন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ানো বিড়াল বাহিনীর কোনও কোনও সদস্য সটান হানা দিচ্ছে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটেও। হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলছেন, ‘‘সাধারণ ওয়ার্ডেই কুকুর বিড়াল ঘুরলে সংক্রমণের ভয় থাকে, সেখানে সিসিএউ-এর মতো ওয়ার্ডে বেড়াল ঢোকার পরিণাম মারাত্মক হতে পারে।’’

জেএনএম-এর সুপার স্নেহপ্রিয় চৌধুরী বলছেন, ‘‘আমরা বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু বেড়াল-কুকুর তাড়ানোর মতো লোকবল, পরিকাঠামো কোনওটাই আমাদের নেই। অবশেষে আমরা প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরে চিঠি লিখেছি। তারা যদি কোনও ব্যবস্থা করে তাহলে পরিত্রাণ পাই।’’

কল্যাণী পুরসভার পুরপ্রধান সুশীল তালুকদারও জানিয়েছেন, কুকুর-বিড়াল ধরার মতো পরিকাঠামো বা কর্মী তাঁদেরও নেই। তবে আশার কথা শুনিয়েছেন প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দফতরের কুকুর-বিড়াল ধরার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে। কল্যাণীর মেডিক্যাল কলেজের বেড়াল-কুকুরের অত্যাচারের বিষয়টি শুনেছি। কী করা যায় দেখছি।’’

আর কান্দি হাসপাতালে শুয়োরের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ রোগী ও রোগীর বাড়ির আত্মীয়েরা বলছেন, ‘‘হাসপাতালে কুকুর-বেড়াল ঘুরে বেড়ায় বলে শুনেছি। তাই বলে শুয়োর! এটা কি হাসপাতাল না খোঁয়াড়? এ তো দেখছি, এক রোগ সারাতে এসে অন্য রোগে আক্রান্ত হতে হবে।’’ যদিও হাসপাতালের কর্মীদের একাংশের অভিযোগ, এর শিকড় কিন্তু রয়েছে হাসপাতাল চত্বরেই। হাসপাতাল চত্বরেই নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের আবাসন। তার পাশেই শুয়োর প্রতিপালন করছেন হাসপাতাল কর্মীদের একাংশ।

এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ কান্দি পুরসভার উপ-পুরপ্রধান কংগ্রেসের সান্ত্বনা রায় বলেন, “স্বাস্থ্য দফতর যে কিছুই করছে না সেটা কান্দি হাসপাতাল চত্বরে গেলেই বোঝা যায়।’’ আর মুর্শিদাবাদের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভাশিস সাহা বলেন, “এমন ঘটনাকে কখনই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। অবিলম্বে ওই হাসপাতালের সুপারের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেব।”

তত দিন সামলে রাখতে হবে মাছ। অসহ্য জেনেও সহ্য করে যেতে হবে শুয়োরের দৌরাত্ম্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement