—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
শিকলে ঝোলানো প্রদীপদানি। তা থেকে আলো ছড়াচ্ছে বড় বড় রেড়ির তেলের প্রদীপ। পুজোর ক’টা দিন চাটুজ্জে বাড়ি চাঁদুনি আলোয় আলোময়। বাড়ির গিন্নীদের জড়োয়া কিংবা বাউটির বহুমূল্য পাথরে সেই প্রদীপ শিখা ঠিকরে উঠে ধাঁধিয়ে দিত চোখ! কবেকার সে কথা। এখন সেখানে শুধুই অন্ধকার। পঙ্খের কাজ করা চাঁদুনি জুড়ে বট অশ্বথের শিকড়ে জটিল নকশা। মাকড়সার জালে পিথাগোরাসের জ্যামিতি। ভোগের ঘরে বাদুড় চামচিকের আড্ডা।
এ সব এখন শুধুই ইতিহাস। নবদ্বীপের অনেক প্রাচীন দুর্গাপুজো সময়ের গতিকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোথাও চিহ্নটুকু পড়ে আছে। কোথাও বা সেটুকুও নেই। ইতিহাস-বিমুখ বাঙালি নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে সেই সব অতীত ঐতিহ্যকে। প্রাচীন জনপদ নবদ্বীপে এমন হারিয়ে যাওয়া দুর্গাপুজোর সংখ্যা নেহাত কম নয়। যেমন, সূর্যকান্ত সপ্ততীর্থের বাড়ি। কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ধাতব মঙ্গলঘট অবহেলায় পড়ে আছে ঘরের কোণে। ধুলোর পরতে ঢাকা পড়ছে মীনের সূক্ষ কারুকাজ। একপাশে অবহেলায় শোয়ানো ৩০০ বছর ধরে মহানবমীতে রক্তপানে অভ্যস্ত বিরাট খড়্গ। জমাট বাঁধা রক্তের মতো মরচে সারা গায়ে। আবার, কান্তি ভট্টাচার্যের বাড়ি অন্তঃপুরিকাদের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস, কোমল চিবুকের স্পর্শ না পেয়ে বিষন্ন নাটমন্দির ঘিরে থাকা ছিন্ন চিক্। পুজোর দিনগুলো যার আড়াল থেকেই ওঁরা উৎসবে মেতে উঠতেন।
হারিয়ে যাওয়া পুজোর অন্যতমটি সে কালের ভারতবিখ্যাত নৈয়ায়িক শঙ্করনাথ তর্কবাগীশের দুর্গাপুজো। প্রবল প্রতাপান্বিত শঙ্করনাথ এই পুজোর জন্য পাঁচ খিলানের প্রকাণ্ড দুর্গামণ্ডপ গড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। কেননা, তখন একমাত্র নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দুর্গামণ্ডপ ছিল পাঁচ খিলানের। শঙ্করনাথ ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত। সভাসদের এই দাপট বড় বিঁধেছিল কৃষ্ণচন্দ্রকে। শোরগোল থামাতে শেষ পর্যন্ত তর্কবাগীশ নিজের দুর্গামণ্ডপের দু’টি খিলান বন্ধ করে দিলেন। ঐতিহাসিক সে মণ্ডপটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
নীলমণি চট্টোপাধ্যায়ের তখন প্রবল দাপট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবদের ধার দেয় যে সব দেশীয় মহাজন, তাদের যাবতীয় ইংরেজি কাগজপত্র তৈরি করে দিতেন নীলমণি। এ কাজে প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছিলেন। চার ঘোড়ায় টানা ফিটনে চড়তেন তিনি। তাঁর বাড়ির দুর্গাপুজো মানে রইরই কাণ্ড। রকমসকম দেখে লোকে বলত— সাহেব বাড়ির পুজো। গত শতকের ছয়ের দশকে পুজো বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের প্রবীণদের পুজোর দিনগুলোয় সম্বল শুধুই স্মৃতি, মনখারাপ।
নিজের হাতে বছরের পর বছর মহামায়ার পুজো করেছেন। বিরাট পরিবার। ভোগ থেকে নৈবেদ্য, একা হাতে সামলেছেন। দম ফেলার ফুরসত মিলত না। পুজো বন্ধ হওয়ার পর সেই সব বাসনপত্র, মঙ্গলঘট দেখলেই পুজোর ক’টা দিন কেবলই কান্না পায়। ১৯৯৬ সালে বাড়ির পুজো বন্ধ হওয়া অবধি আর মা দুর্গার মুখদর্শন করেননি নীলিমা ভট্টাচার্য। তীব্র অভিমানের সঙ্গে পণ্ডিত সূর্যকান্ত সপ্ততীর্থের সহধর্মিনী একবার বলেছিলেন, ‘‘আমার ঘরে যখন মা আসেন না, আমিও তাঁকে দেখব না।’’
বর্ধমানের মথুরা গ্রামের জমিদার রজনীকান্ত মিত্রের দাপটে নাকি বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত। পরবর্তী কালে শহর নবদ্বীপে তিনি এক প্রকাণ্ড বাড়ি করেন। সেখানেই প্রচলন করেছিলেন দুর্গাপুজোর। শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা সেই দুর্গাপুজো এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। রজনী মিত্রের চতুর্থ প্রজন্ম বিনয়ভূষণ মিত্রের জীবদ্দশায় শেষ বার পুজো হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এর দু’বছর পরে তিনি মারা যান। পরিবারের সদস্যদের কথায়, প্রধানত জমিদারির আয় কমে যাওয়া এবং শেষ পর্বে জমিদারি একেবারে না থাকায় পুজোর ব্যয় বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। এমন ভাবেই মতিলাল ভট্টাচার্যের প্রচলিত পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে নবম পুরুষের হাতে। সেও আর্থিক কারণেই। মহোপাধ্যায় ভুবনমোহন বিদ্যারত্নের পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে পঞ্চাশ বছরের বেশি আগে।
আবার, অনেক পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকা সত্ত্বেও বন্ধ হয়ে যাওয়া পুজো শুরু হচ্ছে না কেবলমাত্র লোকাভাবে। স্মৃতির পুজোয় ডুব দিয়ে উৎসবের বিষণ্ণ প্রহরগুলো কাটিয়ে দেওয়াই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন ওঁরা।