এ ভাবেই কষ্ট করে সংগ্রহ করতে হয় জল। যাত্রাপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
নদিয়া জেলার সিংহভাগ ব্লকই আর্সেনিক প্রবণ। জেলা প্রশাসনের একাধিক রিপোর্টে উঠে এসেছে এই তথ্য। আর্সেনিকের মোকাবিলায় জেলার তিনটি ব্লকে গঙ্গার জল শোধন করে সরবরাহ করার প্রকল্পও চলছে। কিন্তু বিশুদ্ধ জল যে জেলার সর্বত্র মেলে না, তার প্রকৃষ্ট উদাহরন করিমপুর-১ ব্লকের যাত্রাপুর গ্রাম। আর্সেনিকে জর্জরিত এই গ্রামে বছর ছ’য়েক আগে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর নলকূপ বসিয়েছিল। কিন্তু মাস খানেক পর থেকে সে সব নলকূপই বিকল হয়ে যায়। সেখান থেকে এক ছটাক জলও পড়ে না। ফলে আর্সেনিক মিশ্রিত অগভীর কলের জলই একমাত্র ভরসা যাত্রাপুরের হাজার দুয়েক বাসিন্দার। গ্রামের লোকজনের দাবি, আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে গত দু’দশকে প্রায় জনা কুড়ি লোকের প্রাণ গিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন জনা পঞ্চাশেক গ্রামবাসী। তবু আর্সেনিক কবলিত এই গ্রামের মানুষ এক প্রকার বাধ্য হয়েই কলের জল পান করছেন। ফলে রোগ সারার তো কোনও বালাই নেই, বরং উত্তরোত্তর বাড়ছে নতুন করে আর্সেনিক আক্রান্তের সংখ্যা।
ব্লক প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, যাত্রাপুর গ্রামের বেশিরভাগ টিউবওয়েলের জলেই আর্সেনিক রয়েছে। এবং তা মাত্রাতিরিক্ত। ফলে ওই জল পান করার ব্যাপারে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু জলের বিকল্পের কোনও জোগান নেই এখানে। সেই আটের দশক থেকে এলাকার লোকজন গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে নাগাড়ে দরবার করে আসছেন। গ্রামেরই এক ব্যক্তি জানালেন, বছর ছ’য়েক আগে সেই দরবার মঞ্জুর করে জন স্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। দফতরের তরফে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিকে গোটা ছয়েক নলকূপ বসানো হয়। গ্রামের মানুষ ভেবেছিলেন, এ বার হয়ত অপরিশ্রুত জল পানের দিন শেষ হতে বসেছে। কিন্তু মাস খানেক পরই দেখা যায়, নলকূপগুলি থেকে একফোঁটা জলও মিলছে না। কেন এমন অবস্থা? জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের ব্লক স্তরের কর্তারা জানাচ্ছেন, আসলে ওই এলাকায় বেআইনি ভাবে অনেক নলকূপ বসানো হয়েছে। ফলে পাইপের শেষতম প্রান্তে জল পৌঁছছে না। আর যাত্রাপুরের নলকূপগুলি পাইপের শেষের দিকে রয়েছে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি দিনকে দিন অবনতি হচ্ছে। গ্রামের এ দিক সে দিক ঘুরে দেখা মিলল বেশকয়েক জন আর্সেনিক আক্রান্ত লোকের। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশাহী গ্রামের নীরেন ঘোষ, শৈবাল দাস, সুরজিৎ ঘোষরা। গোটা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গিয়েছে। কোনও কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন প্রত্যেকেই। করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসক রাজীব ঘোষ জানালেন, ওই এলাকার আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অবস্থা এমন স্তরে পৌঁছেছে, সপ্তাহের ফি বুধবার আর্সেনিক আক্রান্তদের জন্য পৃথক আউটডোরের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, প্রথমে চামড়ার আক্রমন করে আর্সেনিক। পরে তা শরীরে কিডনি, ফুসফুসের মত অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। আর্সেনিক ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। গ্রামেরই বাসিন্দা তথা ও পঞ্চায়েত সদস্যা তৃণমূলের চাঁদমিরা বিবি সর্দার জানান, গত দু’দশকে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে প্রায় কুড়ি জন মারা গিয়েছেন। অনেকক্ষেত্রে কলকাতার নামি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে এসে কেউ কেউ সুস্থও হয়েছিলেন। যদিও তা সাময়িক। কারণ, বাড়ি ফিরে আবার সেই আর্সেনিকযুক্ত জল পান করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। ফলে নতুন করে আক্রান্ত প্রাণ গিয়েছে তাদের। গ্রাম্য চিকিৎসক তথা তৃণমূলের স্থানীয় নেতা রুস্তম মণ্ডলের ক্ষোভ, ‘‘বছর দেড়েক আগে বিশুদ্ধ পানীয় জলের দাবি নিয়ে জেলা পরিষদের সভাধিপতিকে আবেদনপত্র জমা দিই। তিনি ‘সজলধারা’ প্রকল্পে পানীয় জলের কষ্ট মেটানোর প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু আজও কোনও কাজ হয়নি।’’ বানীকুমারবাবু সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘‘আসলে সে সময় ওই প্রকল্পের অর্থে টান ছিল। তাই কিছু করা যায় নি। আশা করি দ্রুত ওখানকার লোকজনের জলকষ্ট মিটবে।’’ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন স্থানীয় বিডিও সুরজিৎ ঘোষও। তিনি বলেন, ‘‘কয়েকমাস আগেই ব্লকের দায়িত্ব নিয়েছি। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সঙ্গে কথা বলে ওই এলাকার পানীয় জলের সমস্যার সমাধান করা হবে।’’ কিন্তু সে সব কবে হবে? এমন প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে ক্লান্ত আর্সেনিক আক্রান্ত বিমলা দাস বা রাজিমুন বেওয়ারা। অশক্ত শরীরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এমন প্রতিশ্রুতি যে তাঁরা বহুদিন ধরেই শুনছেন!