লুঙ্গি পরে পাসপোর্টের দোকানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন দুই গোয়েন্দা।
বহরমপুর কদবেলতলার সেই দোকানের উপরেই লেখা, ‘পাসপোর্ট করে দেওয়া হয়।’ ছদ্মবেশী দুই গোয়েন্দা গিয়ে বলেন, তাঁদের জন্ম শংসাপত্র নেই, কিন্তু দ্রুত পাসপোর্ট করে দিতে হবে। এক গোয়েন্দার কথায়, ‘‘শুনেই ওরা রাজি। নাম-ধাম জেনে কয়েক মিনিটের মধ্যে নকল জন্ম শংসাপত্র তৈরি করে হাজির করে। তখনই নিজেদের পরিচয় দিয়ে দুজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসি।’’
বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে জাল পাসপোর্টের কারবার অনেক দিনের। গত কয়েক দিনে মুর্শিদাবাদে তিন বাংলাদেশি-সহ ১১ জন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের অন্যতম এক পুলিশ কনস্টেবল, যাঁর বাড়ি নদিয়ার শান্তিপুরে। বছর তিন আগে নদিয়ার হাঁসখালিতেও দু’জন গ্রেফতার হয়। শুধু বাংলাদেশিদের ভারতীয় সাজিয়ে জাল পাসপোর্ট বের করা নয়, ডোমকল বা বগুলার মতো যে সব এলাকার বহু মানুষ সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, সিরিয়ায় কাজ করতে যান, সে সব এলাকাতেও এই কারবারের রমরমা। কারণ, আসল পাসপোর্ট পাওয়ার অনেক হ্যাপা, তা সময়সাপেক্ষও বটে।
বহরমপুরে কদবেলতলা এলাকায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয় ঘিরেই চলে দালাল চক্র। পাসপোর্ট অফিস ও জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক শ্রেণির কর্মীও জড়িত বলে অভিযোগ। নিয়ম অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের ২৬ জানুয়ারির পরে যাদের জন্ম, তাদের পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে জন্ম শংসাপত্র লাগে। আর এই জায়গা থেকেই জালিয়াতির সূত্রপাত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দালাল চক্রের এক পান্ডা জানায়, জন্ম শংসাপত্র-সহ জাল পাসপোর্ট করে দেওয়ার জন্য ন্যূনতম ছ’হাজার টাকা লাগে। দেড় হাজার টাকা পাসপোর্ট আবেদন করতে, দু’শো টাকা নকল জন্ম শংসাপত্র তৈরির জন্য। দালালের দাবি, দু’হাজার টাকা নেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মী। যে তাঁর কাছে টাকা পৌঁছে দেয়, তাকে দিতে হয় পাঁচশো টাকা। বাকি ১৮০০ টাকা দালালের লাভ। তার কথায়, ‘‘আমি ছ’হাজার নিই। অনেকে দশ হাজারও নেয়।’’
ওই পাসপোর্ট অফিস ঘিরে যত দালাল, তাদের অধীনে আবার বেশ কিছু ছোট দালাল আছে। তাদের কাজ খদ্দের ধরা। পাসপোর্ট অফিসের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘জন্ম শংসাপত্র নকল বলে সন্দেহ হলে তা দেওয়ার জন্য বিডিও অথবা এসডিও-র কাছে যে আবেদন করা হয়েছিল, তার প্রতিলিপি আনতে বলি। কিছু ক্ষণের মধ্যে ওরা তা-ও এনে দেয়। অর্থাৎ ওদের কাছে সরকারি ও পুরসভার সিলমোহর আছে। কিন্তু পুলিশ ঠিক মতো তদন্ত না করে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ দেওয়ায় অনেক সময়ে ভুয়ো শংসাপত্র দাখিল করেও ওরা পাসপোর্ট পেয়ে যায়।’’ দালালটি জানায়, টাকাপয়সার বিষয় মিটে গেলে পাসপোর্ট অফিসের যে কর্মী তাদের সঙ্গে যুক্ত, তাঁর নাম ও তিনি কোন কাউন্টারে আছেন জানিয়ে দেওয়া হয় আবেদনকারীকে। সেখানে দালালের নাম করতেই জমা দেওয়া নকল কাগজ পাশ করে দেন তিনি।
বছর তিনেক আগে নওদার এক যুবকের নামে পাসপোর্ট পেয়েছিলেন এক বাংলাদেশি নাগরিক। পরে পুনর্নবীকরণের চিঠি পেয়ে সেই যুবক লিখিত অভিযোগ করেন। তদানীন্তন এক তদন্তকারী গোয়েন্দা অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়। শেষমেশ চাকরি যায়নি ঠিকই, অফিসারটিকে ‘ক্লোজ’ করে পরে থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে, শুধু দালাল ধরে আর কী হবে?