লর্ডসে ঝুলন ঝড়

ভাই, দে না নীল গেঞ্জিটা

চৌত্রিশ বছরের মেয়েটা চাকদহ থেকে যে দৌড়টা শুরু করেছিল, তা যেন অকাল ঝড় হয়ে শ্রাবণের দুপুরে আছড়ে পড়ল লর্ডসের মাঠে। শুরুটা হয়েছিল এ ভাবেই।

Advertisement

সৌমিত্র সিকদার

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৭ ০৪:০৯
Share:

চাকদহ-এক্সপ্রেস: রবিবার লর্ডসে ফাইনালে উইকেট নেওয়ার পরে ঝুলন গোস্বামী। এএফপি

মুড়ির ঢাউস বাটিটা ছিটকে পড়েছে... ‘ইস দিদিভাই’, বলটা অফ স্টাম্পের দেড়-চুল দূরত্ব ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। আপামর লর্ডস জুড়ে হিলহিলে হাওয়াটা গ্যালারি ছুঁয়ে যেন চাকদহের লালপুরে আছড়ে পড়ল সেই দুপুরে।

Advertisement

পাশাপাশি সাইকেল যাওয়ার মতো ফিতের মতো সরু গলিটা যেখানে থমকে গিয়েছে, টিনের চালটা নেমে এসেছে ঠিক সেখানেই। প্যাচপ্যাচে কাদা মাখা বারান্দায় ওঠার মুখে চটির স্তূপ। ভিতর থেকে ছিটকে আসছে, কখনও আফশোস, কখনও জোরালো সোল্লাস।

মা-বাবা-ভাই আর ছোট বোন, ঝুলনের আটপৌরে আপনজনদের সঙ্গে লালপুরের বাড়িটা আজ যেন পড়শিদের বৈঠকখানা।

Advertisement

তবে, মেঘ মেঘ দুপুরে বিকেল ছোট হয়ে এলেও সেই মারাত্মক ইনসুইঙ্গারটা কই! ছোট বোন ঝুম্পা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘‘ভাই আমার নীল গেঞ্জিটা দে না, না হলে দিদিভাই উইকেট পায় কখনও!’’ গেঞ্জি এল, আর সেকেন্ড দশেকের মধ্যেই শ্রাবণ আকাশ চিরে রোদ্দুর আনল সারা টেলরের ব্যাট ছুঁয়ে উইকেটের পিছনে চওড়া গ্লাভসে জমা পড়া বলটা।

চৌত্রিশ বছরের মেয়েটা চাকদহ থেকে যে দৌড়টা শুরু করেছিল, তা যেন অকাল ঝড় হয়ে শ্রাবণের দুপুরে আছড়ে পড়ল লর্ডসের মাঠে। শুরুটা হয়েছিল এ ভাবেই। তার পর, কখনও নাতাইল সিভার কখনও বা ফ্র্যান উইলসন, চাকদহ এক্সপ্রেসের গতিতে সরু সেই গলিটায় ছড়িয়ে দিয়ে গেল গলানো রোদ।

গোস্বামী বাড়িতে এ দিন অরন্ধন। পড়শি বাড়ি থেকে তাই ঘন ঘন ডাক আসছে, ‘কই গো দুটো মুখে দিয়ে যান, আমাদের ঝুলনকে মেমসাহেবরা রুখতে পারবে না গো!’ সে ডাকে সাড়া মিলল ঝুলনের প্রথম ওভারটা শেষ হওয়ার পরে।

তবে, ঝুলনের বাবা, নিশীথবাবুর রক্ত চাপ রোখে কে! লম্বাটে খেলার ঘরে আদ্দিকালের ফ্ল্যাট টিভির সামনে পাড়ার ভিড়ে, ভাই-বোন, ঝুম্পা-কুণাল আছে বটে, তবে ওঁরা নেই। পাশের প্রায় দম বন্ধ দশ বাই দশ ঘরে গুম হয়ে আছেন বাবা। আর, ‘তোদের কিছু লাগলে বলিস’ বলে মেয়ের মুখোমুখি হতে চাইছেন না মা।

আরও পড়ুন: ঝুলনদের জন্য কিন্তু গর্বই হচ্ছে

সেই সংস্কারের আড়ালে একে একে খসে পড়ছে উইকেট আর লম্বাটে ছোট্ট ঘরটা কখনও ফেটে পড়ছে চিৎকারে, কখনও বা হা হুতাশে থমকে যাচ্ছে হুল্লোড়ের স্রোত। তারই আড়ালে, দুপুর ফুরিয়ে সাঁঝ নেমেছে চুপিসাড়ে।

আড়াই মিনিট দূরে ঝুলনের ফ্রেন্ডস ক্লাব। রবিবারের দুপুরটা যে সেই এক চিলতে ক্লাব ঘরেও ভেঙে পড়বে, জানতেন ক্লাবের কর্তারা। তাই পাশের প্রাথমিক স্কুলের বারান্দাটাকেই বেছে নিয়েছিলেন, আস্ত জায়েন্ট স্ক্রিনের সামনে সেখানে গোটা লালপুর।

থেকে থেকেই সদ্য বাঁধা স্লোগান উঠছে— ‘বাইশ গজে জিতবে কে, ঝুলন দিদি আবার কে!’ সকাল থেকে গলির মোড়ে এমন ছড়ানো ছিটানো স্লোগানের ছড়াছড়ি— ‘চাকদহ থেকে লর্ডসে ছুট, ঝুলন তোমায় জানাই স্যালুট’।

রবিবার দুপুরে সেই স্যালুট, চাকদহের সরু গলি, রেল লাইন, কাদা মাখা বাজার ছাড়িয়ে এক্সপ্রেসের গতিতে ছুটল লর্ডসের দিকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement