জেলাশাসক, পর্যবেক্ষক আর আমরা। কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
চৈত্র আর ভোটের আঁচে ঘেমে নেয়ে একসা শ’তিনেক ছাত্রীর দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে নিজেই হকচকিয়েই গিয়েছিলেন জেলাশাসক।
প্রশস্ত ক্লাসরুমের দেওয়াল বরাবর চোখ বুলিয়ে— নাঃ, অনেক খুঁজে পেতে চোখে পড়ছে সাকুল্যে দু’টি হাত। আড়চোখে দেখলেন পাশে বসে থাকা কমিশন কর্তাও চোখ ঘুরিয়ে সদর্থক হাতের খোঁজ করছেন। রুমালে কপাল মুছে অগত্যা তাঁকেও বলতে হল, ‘‘সিরফ দো!’’
ভরা ভোটের মুখে, নিবার্চন কমিশনের বিশেষ নজরদারি দলের রাজীব জৈনের সামনে সচেতনতার ক্লাস শুরু করেছিলেন নদিয়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতী। মঙ্গলবার সকালে সেখানেই তাঁর প্রশ্ন ছিল— ‘‘তোমরা ক’জন নেতা হতে চাও, হাত তোল তো।’’ কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের ক্লাসঘরে জড়তা নিয়ে তুলে ধরা দু’টো হাত বুঝিয়ে দিল রাজনীতির শীর্ষ পদের দিকে তাঁদের তেমন নজর নেই।
আগ্রহ যে নেই, দেশের প্রশাসন চালানোর কারিগর হওয়ার দৌড়েও জেলাশাসকের দ্বিতীয় প্রশ্নেও তা মালুম হয়েছে। হাত উঠেছিল মেরেকেটে গোটা কুড়ি। বিজয় জিজ্ঞেস করেছিলেন—‘‘তাহলে প্রশাসনিক পদে কারা কারা চাকরি করতে চান?’’
নির্বাচন কমিশনের কর্তার সামনে জেলাশাসককে আরও কিছুটা বিড়ম্বনায় ফেলে দিল তৃতীয় প্রশ্নের সামনে ক্লাস জুড়ে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যাওয়ার ছবিটা— ‘‘এ বার বলো তো ক’জন প্রাথমিক স্কুলে পড়াতে চান?’’ অবাক হয়ে দুই প্রশাসনিক কর্তা দেখেছিলেন গোটা ক্লাস যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে।
নতুন প্রজন্ম শুধু নেতা নয়, প্রসাসনের শীর্ষ পদেও যে অপারগ তা দেকে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলেন কি কমিশন কর্তা? জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ঘনিষ্ঠদের কাছে তাঁকে বলতেও শোনা গিয়েছিল, ‘বাংলা এত রাজনীতি-বিমুখ, জানতান না তো!’
দুয়ারে নির্বাচন, এলাকায় শুরু হয়ে গিয়েছে ভোট-প্রচার। তবে তাকে যে ওই ছাত্রীদের অনেকেই নিছক ‘ভোট-ভিক্ষা’ বলে দেখছেন, অকপটে জানিয়েছেন তাঁরা।
কমিশনের নির্দেশে ওই কলেজে এ দিনের কর্মশালা শেষে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের একাঁশও তাই হা-হুতাশ করছেন— ‘‘দেখেছেন রাজনীতির প্রতি কতটা অনীহা!’’
এক কমিশন কর্তার কথায়, ‘‘এই অনীহাটা ভোট দিতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ঘটে কিনা দেখার। নেতা হওয়ার প্রতি অনীহা তাকলেও সাধারণ ভাবে রাজনীতির ক্ষেত্রেও তা থাকতে পারে। এটা খুব বিপজ্জনক ট্রেন্ড।’’ নজরদারি দলের পর্যবেক্ষকরা জেলায় এসে বারবারই জানতে চাইছিলেন, নতুন প্রজন্মের ভোটারদের নির্বাচন নিয়ে কতটা উৎসাহ রয়েছে। তাদের ভোট দানে জেলা প্রসানই বা কতটা উৎসাহীত করতে পারছে, কমিশন দেখতে চাইছে তা-ও। সেই প্রশ্ন অন্তত কৃষ্ণনগরের ওই কলেজে ধাক্কা খেল এ দিন।
নতুন ভোটারদের আরও বেশি বুথ মুখি করার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই জোর দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ছাত্রছাচ্রীদের সহ্গে কথা বলে তাদের অভাব-অনুযোগ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতেও চাইছেন তাঁরা। মঙ্গলবারও ওই বিশেষ পর্যবেক্ষক তেহট্ট-১ ব্লক অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘এই জেলায় বেশ কিছু ভাল কাজ হয়েছে। ভোটদানের হারও ভাল, ৮৫ শতাংশ।’’
সেই উৎসাহেই যেন ভাটা পড়ল ওই কলেজের অনীহায়। তবে, এর পরেও ওই কমিশন কর্তা অবশ্য হাল ছাড়ছেন না। বলছেন, ‘‘আমাদের আরও বেশি করে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের উৎসাহিত করতে হবে। তাদেরকে আরও সচেতন করতে হবে।’’ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে তিনি জেলাশাসকে নির্দেশও দিয়ে গেলেন, ‘‘কলেজগুলোতে এই ধরণের সচেতনতা কর্মশালা করতে হবে। এটা খুবই জরুরী।’’
কিন্তু তারপরও কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে শুধু এই ধরণের কর্মশালা করেই কি সমস্যার সমাধান করা যাবে। নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করা যাবে? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিতেই প্রায় সমস্বরে ‘না’ জানিয়ে দিল কর্মশালায় উপস্থিত কয়েকজন ছাত্রী। কেন?
তাদের কথায়, ‘‘নেতা আর রাজনীতিকে আলাদা করা যাবে না। নেতারা যে ভাবে প্রকাশ্যে অন্যায়, করছেন ঘুষ খাচ্ছেন সেটা দেখে কি করে ভাবি বুলন তো আমি নেতা হব। সমাজে এখনও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের অনেক সম্মান আছে।’’