সাত দিন টানা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন এক জন। বিরামহীন। সাইকেলের সিটে বসেই তিনি খাচ্ছেন, রাতে ঘুমোচ্ছেন। সাত দিনের আগে তিনি সাইকেল থেকে মাটিতে পা রাখবেন না— জলঙ্গির সাদিখাঁরদিয়াড়ের হাফিজুল শেখের মুখে সে কথা চায়ের দোকানে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে চুপটি করে শুনছিলেন প্রৌঢ় রেজাউল করিম।
আচমকা তিনি বলছেন, ‘‘শোনো হে ছোকরা, টানা সাত দিন সাইকেল চালানো দেখেই এত লাফাচ্ছ! এক বারও মাটিতে পা না রেখে আমি টানা ১৫ দিন সাইকেল চালিয়েছি।’’
তখন হ্যাজাকের আলোয় রাত হয়ে যেত দিন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাইকেলে খেলা দেখিয়ে মনোরঞ্জন করে চলেছেন তিনি। গাঁ-গঞ্জের মেয়ে-বউয়েরাও সেই খেলা দেখতেন। কেউ ভালবেসে খাবার দিয়ে যেতেন, কেউ দিতেন ঘরের দুধ।
চায়ের দোকানের মালিকও মুচকি হেসে বলছেন, কত্তা এত রাগ করলে হবে! এরা আপনাকে চিনবে কি ভাবে? আপনি যখন সাইকেল খেলা ছেড়েছেন, তখন এরা কোথায়! এদের বাপ-চাচারা আপনার খেলা দেখেছে।’’
নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো আজ তাঁকে চেনে না। কিন্তু এক সময়ে সাইকেলের খেলা দেখিয়েই গোটা এলাকায় নাম-যশ ছড়িয়েছিল সাদিখাঁরদিয়াড়ের নওদাপাড়া গ্রামের রেজাউল করিমের।
সাইকেল কাঁধে নদিয়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি ভিন রাজ্যেও ছুটতে হত তাঁকে। মোটা টাকার বায়না দিয়ে নিয়ে যেত বিভিন্ন ক্লাব ও সংস্থা। নওদাপাড়ার কাঁচা রাস্তায় চার চাকা ঢুকতে দেখে অবাক হতেন অনেকেই। তিনি বলছেন, ‘‘তখন গাঁয়ের মেয়ে-বউয়েরা লাইন দিয়ে ঘটিতে করে দুধ, ডিম, ডাব এনে দিত। সাইকেলের খেলা দেখানোর সময়ে যে ভালবাসা পেয়েছি, তা কোনও দিন ভুলব না।’’
সেই সময়ে সাইকেল খেলাকে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মত। বড় থেকে ছোট সকলেই ভিড় করত গণ্ডি দেওয়া দাগের পাশে। এক বার সাইকেল চালানোর সময়ে রড বাঁকানোর খেলা দেখানোর সময়ে সহকারীর ভুলে জখম হন তিনি। তা দেখে পাড়ার লোকজন দ্রুত সাদিখাঁরদিয়াড় গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল বলেই সে বার প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
এখন সাইকেল খেলার সে দিন নেই। স্মৃতিকাতর রেজাউল বলছেন, ‘‘জানেন, এখনও স্বপ্নে দেখি বনবন করে ঘুরছে সাইকেলের চাকা!’’