সংস্কারের অপেক্ষায় বগুলার একমাত্র প্রেক্ষাগৃহ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
এ শহরের সঙ্গে নাটকের সম্পর্ক নিবিড়। সীমান্তের শহর বগুলার নামডাক হয়তো সেই অর্থে নেই। কিন্তু শহরের নাট্যচর্চা বিদ্বজ্জন মহলে বিস্তর প্রশংসা কুড়িয়েছে। এই সে দিনও বগুলার নাট্যোৎসবে যোগ দিতে আসত কলকাতা-সহ নানা জেলার একাধিক দল। শহরের মানুষ আর পাঁচটা উৎসবের মতোই নাট্যোৎসবেও সমান ভাবে যোগ দেন। অথচ শুধু একটা আধুনিক মানের প্রেক্ষাগৃহের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে বগুলার নাট্যচর্চা!
এই শহর কতটা নাটক পাগল তা গত বছর টের পেয়েছিল শহরের বাইরে থেকে আসা নাট্যদলগুলি। গত বছরের এপ্রিলে দু’দিনের নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিনে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল মঞ্চ। উল্টে গিয়েছিল লাইট, মাইক। কিন্তু ঝড় জল থামতেই মঞ্চ ঠিক করার কাজে সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছিলেন দর্শকেরা। সে দিন দর্শকের অনুরোধেই নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন নাটকের দলগুলি। আর জমা জলে পা ডুবিয়ে সেই নাটক উপভোগ করেছিল বগুলা। অথচ এমন একটা শহরের মানুষ শুধু একটা উপযুক্ত প্রেক্ষাগৃহের অভাবে নিয়মিত নাটক দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তবে প্রেক্ষাগৃহ একেবারেই নেই যে তা নয়। বগুলা পঞ্চায়েত অফিসের পাশে রয়েছে শহরের একমাত্র প্রেক্ষাগৃহ। সংস্কারের অভাবে সেই প্রেক্ষাগৃহ এখন পোড়ো বাড়ির চেহারা নিয়েছে। মূল ফটকের সামনে ডাঁই হয়ে রয়েছে জঞ্জালের স্তূপ। দেওয়ালে পড়েছে শ্যাওলার আস্তারণ। রঙচটা দেওয়াল দেখলেই বোঝা যায় গোটা বাড়িটাই কী অনাদরে পড়ে রয়েছে। প্রেক্ষাগৃহের অবস্থা এতটাই বেহাল যে হতাশ নাট্যকর্মীরা এখন ওই মঞ্চে নাটক মঞ্চস্থ করা ছেড়ে দিতে শুরু করেছেন। অথচ ওই বাড়িটাই বগুলার সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত।
শুধু নাটকই নয়। নাচ বা গানেও প্রান্তিক এই শহর জেলার মধ্যে বেশ পরিচিত। সেখানেও একই অবস্থা। শিল্পীরা জানান, প্রেক্ষাগৃহের এমন করুণ অবস্থা যে, সেখানে কোনও অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। বগুলার সাংস্কৃতিক জগতে পরিচিত নাম ‘থিয়েটার যোগ’। সংস্থার সভাপতি অরুণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘সাজঘর থেকে শুরু করে সাউন্ড সিস্টেম সবেরই অবস্থা বেহাল। প্রেক্ষাগৃহের ভিতরে ঢুকলে তা স্পষ্ট বোঝা যায় কতটা দায়সারা ভাবে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। তার উপরে দীর্ঘ দিন ধরে কোনও সংস্কার হয়নি। ফলে এখন যা অবস্থা তাতে নাটক মঞ্চস্থ করাই কঠিন।’’
তাঁর আক্ষেপ, ‘‘একটাই মাত্র সাজঘর। ছেলেমেয়ে সকলকে তাই এক ঘরে পোশাক বদলাতে হয়। প্রেক্ষাগৃহটা এত অপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, পিছনের দিকে বসলে শব্দ পরিষ্কার ভাবে শোনা যায় না। প্রেক্ষাগৃহের নিজস্ব আলোর ব্যবস্থা নেই। ভাবতে পারেন, প্রেক্ষাগৃহে একটা পাখা পর্যন্ত নেই!’’
এই শহরের পরিচিত আরও একটি নাটকের দল ‘অবয়ব’। সংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘নানা কারণে আগের মতো সাড়া জাগানো নাটক মঞ্চস্থ করতে পারছি না। তার প্রধান কারণ হল উপযুক্ত প্রেক্ষাগৃহের অভাব। বাইরে মঞ্চ বেঁধে নাট্যোৎসব করতে প্রচুর খরচ। সেই সঙ্গে চাই লোকবল। এই মুহূর্তে দু’টোই জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’’ নাট্যকর্মীদের আক্ষেপ, আমন্ত্রণ পেয়ে শহরের বাইরে নাটক মঞ্চস্থ করে এলেও এলাকার মানুষকে তাঁদের অভিনয় দেখাতে পারছেন না। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বগুলার নাট্যোৎসব।
এই মুহূর্তে যে ক’টি নাট্যগোষ্ঠী নিজেদের ধরে রাখতে পেরেছে তাদের মধ্যে একটি হল ‘সূচনা নাট্যগোষ্ঠী’। সংস্থার সম্পাদক সৃজন বলেন, ‘‘একটা উন্নত মানের প্রেক্ষাগৃহ না থাকায় বাইরে মঞ্চ তৈরি করে ফি বছর নাট্যোৎসব করি। তাতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। যেটা আমাদের মতো স্বল্প পুঁজির নাট্যদলের পক্ষে বহন করা দিনকে দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এ ভাবে কতদিন টানতে পারব
জানি না।’’
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রেক্ষাগৃহটি তাদের সম্পত্তি হলেও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব হাঁসখালি পঞ্চায়েত সমিতির। তারাই প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া দেয়। পঞ্চায়েত সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৮৭ সালে এই প্রেক্ষাগৃহ তৈরির কাজ শুরু হয়। পরে ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। নাম দেওয়া হয় ‘সাংস্কৃতিক মঞ্চ’। পরে নাম পাল্টে ‘গুরুচাঁদ ভবন’ রাখা হয়। পঞ্চায়েত সমিতির তৎকালীন সভাপতি কংগ্রেসের শঙ্কর চক্রবর্তী জানান, আগে ওই জায়গায় একটি ডাকবাংলো ছিল। জেলা পরিষদ সেখানে একটি মুক্তমঞ্চ তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। পরে মত পাল্টে একটা পূর্ণাঙ্গ প্রেক্ষাগৃহ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কিন্তু উপযুক্ত পরিকল্পনা ছাড়া এ ভাবে তৈরি হল কেন? শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘যখন কাজ শুরু হয় তখন যে নকশা ছিল পরে সেটা বদলে যায়। সেটাও একটা বড় কারণ বলতে পারেন।’’ জেলা পরিষদ সদস্য কল্যাণ ঢালি অবশ্য বলেন,‘‘প্রেক্ষাগৃহটি ঢেলে সাজানো হবে। সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প ও সাংসদের তহবিল থেকে টাকা পাওয়ার কথা রয়েছে।’’
প্রতিশ্রুতি নয়, বগুলা চায় প্রেক্ষাগৃহ সংস্কার করে গতি আসুক বগুলার নাট্যচর্চায়।