আজকের কথা নয়। বেশ কয়েক দশক ধরে ডোমকলের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ‘বোমকল’। এত বোমা পড়ত যে, ডোমকলের মানুষই ওই বোমকল নামটি দিয়েছিলেন। তখন দেখা যেত, পুলিশ সক্রিয় থাকলেও, গোপনে কাজ করত দুষ্কৃতী চক্র। এমনকি, বোমায় নিহতদের অনেক সময় খোঁজও পেত না প্রশাসন। কোথায় তাদের চিকিৎসা হত, কে তাদের সে সব গোপন জায়গায় নিয়ে যেত, তা জানত খুব কম লোক। কিন্তু বড় ঘটনা ঘটলে তা প্রকাশ্যে এসে যেত।
যেমন, ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোট। রাজ্যের ক্ষমতায় বামেরা। কিন্তু মুর্শিদাবাদে প্রায় নিধিরাম সর্দারের মতো অবস্থা তাদের। অধীর চৌধুরীর কংগ্রেস তখন রীতিমতো বাম দুর্গে থাবা বসিয়েছে। ডোমকল তখন বারুদের স্তূপ। নির্বাচনের দিন এখানেই রাজনৈতিক হানাহানিতে খুন হয়েছিলেন দু’পক্ষের ১৩ জন।
কিন্তু খাতায় কলমে ১৩ জন হলেও ওই নির্বাচনের আগের দিন এমনকি নির্বাচনের পরেও বেশ কিছু মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়ে গিয়েছিল সকলের অগোচরে। কারণ কখনও পরিবার ময়নাতদন্তে কারণে এড়িয়ে গিয়েছে বিষয়টি। আবার কখনও পুলিশ মৃতদেহের সংখ্যা কমাতে চেয়েছিল উপর তলার চাপে বলে দাবি।
তৎকালীন ডোমকলের এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘এ ছাড়া আর কী বা করার ছিল আমাদের বলুন? ঘাড়ে করে একের পর এক লাশ বইছি। এখনও রাতে ঘুমোতে গিয়ে সে দিনেরকথা মনে পড়লে চমকে উঠি। আর উপর তলার কর্তাদের চাপ, মৃতদেহের সংখ্যা যেন আর না বাড়ে। কিন্তু ডোমকল থামছে না, সকাল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাগাড়ে খবর আসছিল আমাদের কাছে। শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু পরিবার চুপচাপ মৃতদেহ মাটি দিয়ে দিচ্ছে দেখেও, না দেখার ভান করেছিলাম।’’
বোমা-গুলির লড়াই আর মৃত্যু নিয়ে ডোমকলের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এখনও অনেক ঘটনা পাওয়া যাবে। কখনও খাতা কলমে সেই মৃত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। কখনও আবার গোপনেই মৃতদেহ কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বামেরা সব দোষ বিরোধীদের ঘাড়ে চাপালেও ডোমকলের সাধারণ মানুষ জানে সেই সময়ের মৃত্যু মিছিলের দায় ছিল তাদের। এক দিকে ক্ষমতায় তাদের সরকার, আর পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, তা অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই বাম নেতাদের। সেই দায় কিছুটা স্বীকার করলেও সিপিএমের জেলা সম্পাদক জামির মোল্লা বলছেন, ‘‘সেই সময়ে কারা খুন করেছিল সেটা সাধারণ মানুষ জানে। তবে ডোমকলে বর্তমানে যেটা হচ্ছে তা শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল। পেশি শক্তির পরিচয় দিতে গিয়ে, আর আগামী গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে কোন গোষ্ঠী ক্ষমতা ধরে রাখবে, তার প্রমাণ দিতে আর পঞ্চায়েতের অর্থ ভাগ বাঁটোয়ারা করতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটছে। তা ছাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনের এটা একটা মহড়াও বটে।’’
সম্প্রতি ডোমকল থেকে বেশ কয়েকটি বোমা উদ্ধার হয়েছে। তাতেই আবার সেই সব দিনের স্মৃতি ফিরে এসেছে সাধারণ মানুষের মনে।
ডোমকলের বিধায়ক তৃণমূলের জাফিকুল ইসলাম বলছেন, ‘‘বামেদের মুখে এমন দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে গালভরা বক্তব্য বড্ড বেমানান। কারণ তাদের আমলেই আক্ষরিক অর্থে ডোমকল ‘বোমকল’ হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে যে দু’একটি ঘটনা ঘটেছে তা একেবারেই ব্যক্তিগত সমস্যা। যার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগাযোগ নেই। আর বাম আমলে যে বোমাবাজি হত তা ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা মাফিক করা হয়েছে।’’
একটা সময় ডোমকলে সন্ধ্যা নামলেই বোমার শব্দে কেঁপে উঠত গ্রাম। আর বোমা বাধতে গিয়ে বা বোমার ঘায়ে মৃত্যু এবং জখমের ঘটনা লেগেই থাকতো ডোমকলে।
বাম জমানার অবসান হতেই বোমা গুলির লড়াই কমতে থাকে। মূলত সেই সময়ের রাজনৈতিক সমীকরণের জন্যই ওই পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে দাবি রাজনৈতিক মহলের। কারণ তখনও ডোমকলে যুযুধান বাম কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেও রাজ্যের ক্ষমতায় তৃণমূল। আর ডোমকলে তখনও তৃণমূলের অস্তিত্ব না থাকায় পুলিশ প্রায় খোলা হাতে ব্যাটিং করতে পেরেছিল দুষ্কৃতীদের উপরে। আর তাতেই চেহারা বদলে ছিল ডোমকলের। কিন্তু সাধারণ মানুষ অল্প কিছু দিনের মধ্যে আবারও গোটা কয়েক গুলি বোমা কাণ্ড ঘটে যাওয়ায় ঘর পোড়া গরুর মতোই সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছেন।
যদিও জেলার পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার বলছেন, ‘‘ডোমকলে যে ঘটনাগুলি ঘটেছে তা নিছক পারিবারিক অথবা গোষ্ঠীগত। এর মাঝে রাজনীতির কোন রং নেই। তা ছাড়া সব ক’টি ঘটনাতেই একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’
পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার বলেন, ‘‘বোমা বাঁধতে গিয়ে যারা জখম হয়েছেন তাদের ক্রিমিনাল রেকর্ড তেমন কিছু নেই। ফলে একেবারে নতুন হাতে কাজ করতে গিয়ে এমনটা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমরা গোটা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখে তদন্ত করছি এবং অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালানো হচ্ছে নাগাড়ে।’’
এখন দেখার পুলিশ কতটা খোলা হাতে ব্যাটিং করতে পারে।
(চলবে)