কল্যাণীতে প্রায় ফাঁকা সভায় বক্তা জগন্নাথ। নিজস্ব চিত্র
মতুয়া সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিজেপির অন্দরে টানাপড়েন শুরু হয়ে গেল নদিয়ায়। রবিবার মতুয়া মহাসঙ্ঘের দক্ষিণ জেলা নেতৃত্বের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে সেই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকারের উপরে আপাতত টেক্কা দিতে লোকসভা ভোটের টিকিট পেয়েও ফস্কানো চিকিৎসক মুকুটমণি অধিকারী। উল্টে মতুয়াদের অন্য একটি অংশকে নিয়ে সভা করতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়লেন জগন্নাথ।
বিজেপির নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলার প্রধান শক্তিই এই মতুয়া সম্প্রদায়। গত লোকসভা নির্বাচনে মূলত এঁদের ভোটেই বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। যদি দলীয় কোন্দলে সেই ভোট ধরে রাখতে না পারা যায় তা হলে আসন্ন বিধানসভা ভোটে ধাক্কা খেতে হতে পারে। যদিও সদ্য ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ’-এর দক্ষিণ জেলা সভাপতির পদ পাওয়া মুকুটমণি বলছেন, “সবাইকে নিয়েই আমরা জেলায় সংগঠন আরও শক্তিশালী করব।”
বিজেপি সূত্রের দাবি, এখন শুধু মতুয়া সম্প্রদায়ের ভিতরেই নয়, দলের ভিতরেও জগন্নাথকে কোণঠাসা করতে চাইছেন মুকুটমণিরা। এই পরিস্থিতিতে মতুয়া সংগঠনের জেলা সভাপতির পদ পাওয়ায় সুবিধা হয়ে গেল মুকুটমণির, চ্যালেঞ্জ বাড়ল জগন্নাথের। তবে বসে নেই জগন্নাথও। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে তিনি এখন শান্তনুর দাদা সুব্রত ঠাকুরের নৌকায় পা দিয়েছেন। ঠাকুর পরিবারের অভ্যন্তরীণ বিবাদকে কাজে লাগিয়ে তিনিও মতুয়াদের মধ্যে নিজের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া। কিন্তু এ দিনই কল্যাণীতে সুব্রতকে নিয়ে সভা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। সভায় কিছু লোকজন হইচই শুরু করে, কালো পতাকাও দেখানোও হয়। শেষমেশ প্রায় ফাঁকা ময়দানে বক্তৃতা করতে দেখা যায় জগন্নাথকে।
কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস খুন হওয়ার পর থেকেই নদিয়ায় মতুয়াদের মধ্যে তৃণমূলের প্রভাব দ্রুত কমতে থাকে। পরিবর্তে প্রভাব বাড়তে থাকে বিজেপির। মতুয়া ভোটের কথা মাথায় রেখেই গত লোকসভা ভোটে মুকুটমণিকে প্রার্থী করতে চেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু তাঁর প্রার্থীপদের বৈধতা না থাকায় শেষ পর্যন্ত তৎকালীন দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি জগন্নাথ সরকার প্রার্থী হন। এবং বিপুল ভোটে জিতে সাংসদও হন।
প্রথম থেকেই মতুয়া সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই নেতা মুকুটমণি ও জগন্নাথের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। জগন্নাথ সাংসদ হয়ে গেলে তাঁকে সাংগঠনিক জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়কে বসানো হয়েছিল। সেই জেলা কমিটিতে অন্যতম সম্পাদক করা হয় মুকুটমণিকে। পরে মানবেন্দ্রকে সরিয়ে আবার সভাপতি করা হয় জগন্নাথ ঘনিষ্ঠ অশোক চক্রবর্তীকে। সেই কমিটি থেকে বাদ যান মুকুটমণি। এরই মধ্যে মতুয়াদের বিজেপি প্রভাবিত সংগঠনের সঙ্ঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুরের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় জগন্নাথের। উল্টে শান্তনুর ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন মুকুটমণি। পরিস্থিতি এতটাই জটিল আকার নেয় যে জগন্নাথ আমন্ত্রিত না হয়েও কৃষ্ণগঞ্জে মতুয়াদের একটি কর্মসূচিতে গিয়ে উপস্থিত হওয়ায় কর্মসূচি বাতিল করে দেন শান্তনু।
তবে আপাতত এ সবের মধ্যে যেতে নারাজ মুকুটমণি। তিনি বলেন, “সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব আমার উপরে ভরসা রেখেছেন, এতে আমি গর্বিত।” যা শুনে জগন্নাথের প্রতিক্রিয়া, “আমি মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ হলেও সংগঠনের নিময়কানুন বিশেষ জানি না। ফলে কে কাকে কোন পদ দিচ্ছেন, তার বৈধতা কতটা সেটাও বলতে পারব না।” অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের তৃণমূলপন্থী সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি তথা কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে দাঁড়ানো প্রমথরঞ্জন বসুর কটাক্ষ, “ওদের সংগঠনই বৈধ নয়। ওরা আমাদের নাম ব্যবহার করছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা আদালতে যাব। আর মানুষ যে ওদের জালিয়াতি ধরে ফেলেছে, সেটা বিধানসভা ভোটেই বুঝিয়ে দেবে।”
জেলা সভাপতি পদ থেকে সদ্য অপসারিত মতুয়া সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের নেতা সুনীলকুমার ঠাকুর বলছেন, “আমি শুধু মতুয়া সংগঠনটাই করি। কিন্তু ক্রমশ রাজনীতির দলাদলি ঢুকে পড়ছে সংগঠনে। আমি কোনও নেতার ঘনিষ্ঠ নই। হয়তো সেই কারণেই সরে যেতে হল।”
(সহ-প্রতিবেদন: মনিরুল শেখ)