শ্রমের দ্বারাই দুনিয়ার অগ্রযাত্রা। সভ্যতার রূপায়ণও ঘটেছে শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাতে আঘাতে। শ্রম করলেই শ্রমিক— এটা যেমন ঠিক, আবার শ্রমিক বলতে প্রথমে শিল্প শ্রমিকের ধারণা এলেও শ্রমজীবী মানুষের বিস্তৃতি আরও অনেক বেশি। কারণ, পৃথিবীর সব মানুষই কোনও না কোনও কাজ করে আর যে কোনও কাজ করতে গেলেই প্রয়োজন হয় শ্রমের। এই হিসাবে পৃথিবীর সব মানুষকেই শ্রমিক হিসাবে অভিহিত করা যায়। আবার মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শ্রমিকশ্রেণি হল সবচেয়ে আধুনিক এমন এক শ্রেণি যারা সমাজবিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে।
কার্ল মার্ক্স কারখানার শ্রমিকদের বিপ্লবী শ্রেণি হিসাবে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন। কারণ তাঁরা শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন শ্রমিক শ্রেণি হিসেবে দাস ব্যবস্থার বিপরীতে উঠে এলেও তাঁরা কারখানার এক ছাদের তলায়, একই স্বার্থে একটি সংগঠিত শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। আর তাঁদের হারানোর কিছু নেই। তাঁরা সর্বহারা। জমি থেকে উৎখাত হওয়া, জনমজুর বা ভূমিহীন কৃষক যখন শ্রমিকে পরিণত হয়, তখন তাঁদের শ্রমশক্তি ছাড়া উপার্জনের আর কোনও উপায় নেই। তাই, তাঁদের হারানোর কিছু নেই। আব্রাহাম লিঙ্কন যথার্থই বলেছেন— ‘'Labor is the superior of capital and deserves much the higher consideration.''
শ্রমজীবী বলতে কায়িকশ্রম এবং মেধাশ্রম। উভয় শ্রমের বিনিময়ে জীবনধারণ যারা করে তারাই শ্রমজীবী। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত যে কোনও ব্যক্তি, সে কৃষি বা শিল্প যে ক্ষেত্রই হোক না কেন, তিনিই শ্রমিক। মানুষের শ্রম ও চেতনা এই দুই হল সকল সামাজিক সম্পদের উৎস। পেশি ও মস্তিষ্কের শ্রম একত্রে যুক্ত হয়েই সৃষ্টি হয় সভ্যতার যাবতীয় সমাহার।
শ্রমজীবী মানুষের হাতে সভ্যতার যাবতীয় সৃষ্টি সাধিত হলেও আধুনিক পুঁজিবাদী সভ্যতা সেই শ্রমজীবী মানুষকেই পদানত করে রেখেছে। অতীতে বণিক পুঁজির বিকাশের স্বার্থে প্রয়োজন ছিল শোষক সামন্ত সমাজের শৃঙ্খল ভাঙার। তাই ক্রমবিকাশমান জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পকলা একদিকে যেমন বণিকপুঁজির মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করল, একই সঙ্গে ভূমিদাস-সহ অবহেলিত নাগরিকদের মানুষের মতো করে বাঁচার আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করল। ফলে, ইতিহাসে অর্ধ-শতাব্দী কালের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল একটি বড় ধরনের বিপ্লব। যা হল শিল্পবিপ্লব। আঠারো শতকের মধ্যভাগে এই শিল্পবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে স্বতন্ত্র ভাবে একটি শ্রমিক শ্রেণি গড়ে ওঠে। কুটির শিল্প এবং ছোট ছোট শিল্প-কারখানার স্থলে বসল মাঝারি ও ভারী শিল্প কারখানা। শিল্পপুঁজির দানবীয় বিকাশ বিবেচনাহীন ভাবে গ্রাস করে চলল শ্রমিকের শ্রমশক্তিকে।
ভূমিদাস পরিণত হল মজুরিদাসে। শ্রমিকদের বাঁচার মতো ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হল। ক্রীতদাসদের সঙ্গে যে রকম আচরণ করা হত, শ্রমিকের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। দিনে ষোলো ঘণ্টা কাজ করতে হত শ্রমিকদের। ১৮৬৬ সালে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময়ের প্রথম দাবি ওঠে আমেরিকার বাল্টিমোর শহরে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। হে মার্কেটে ধর্মঘটী শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ছয় জন শ্রমিক। এর প্রতিবাদে ৪ মে হাজার হাজার শ্রমিক ফেটে পড়েছিলেন বিক্ষোভে। সে দিনও পুলিশের গুলিতে ৫ জন শ্রমিক মারা যান। আন্দোলন গড়ে তোলার অপরাধে কয়েক জন শ্রমিককে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়।
সভাস্থলে মৃতপ্রায় এক কিশোর তার রক্তে সিক্ত জামা খুলে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিল, যা আজও লাল পতাকা হিসাবে পরিচিত। সে দিন শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার ফলাফল হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে অসন্তোষ। অন্য দেশের শ্রমিকেরাও একাত্মতা প্রকাশ করে সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দেন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যথার্থই লিখেছিলেন— ‘‘লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে / কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকার?’
যখন পরিস্থিতি আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন সরকার-সহ ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে রাজি হয়। পৃথিবীর বুকে নতুন এক ইতিহাসের জন্ম হয়। শ্রমিকেরা সংগঠিত হয়ে লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে থাকেন। শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কর্মসময়ের দাবি এখন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ‘International Labour Organization’ (ILO)-এর সনদেও এটি অনুমোদিত।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সকল শ্রমিক শ্রেণির কাছে মে দিবস হল নতুন সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার শপথের দিন। এই দিন দীর্ঘ দিনের আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল।
বর্তমানে শ্রমজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব শ্রমজীবী মানুষের হাতে নেই। ফলে, কত অসহায় শ্রমিক শোষক সমাজের নিষ্ঠুর পীড়নে নিঃশেষিত হচ্ছে। আরও চিন্তার বিষয় হল, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ শ্রমজীবী মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই আজও অধিকার বঞ্চিত। শ্রমিকেরাই হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মালিকের জন্য খাদ্য-বস্ত্র উৎপাদন করেন, বাসস্থান নির্মাণ করেন। অথচ, এই শ্রেণির লোকেদের কঠোর শারীরিক শ্রম ছাড়া নিজেদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশেই শ্রমিকদের অধিকার-সংক্রান্ত ILO-এর সনদ আজও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। যে সব দেশে কার্যকর হয়েছে, সে সব দেশে প্রায়শই তা লঙ্ঘিত হতে দেখা যাচ্ছে।
আমাদের দেশেও শ্রমিকের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, নানা ক্ষেত্রে নানা ভাবে উপেক্ষিত। দেশের প্রচলিত আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও অনেক শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়। এখনও শ্রমিক শ্রেণি সামাজিক ভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি। অথচ, কাজ কাজই, তা যে প্রকৃতিরই হােক না কেন। মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও দৈহিক কাজের মধ্যে পার্থক্য করা সভ্যতার পরিপন্থী। দরকার শ্রম ও শ্রমিকদের মর্যাদা নিশ্চিত করা।
আমাদের দেশে শ্রমিকদের জন্য যে সব আইন প্রণীত আছে, তা শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় যথেষ্ট নয়। এই সব আইনকে আরও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। সম্প্রতি সারা বিশ্ব যখন নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে চিন্তিত, তখন কিন্তু শ্রমিকেরা চিন্তিত তাঁদের খালি পেট নিয়ে। কার্যত অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটছে ওঁদের। একমুঠো ভাতের পরিবর্তে মিলছে শুধুই আশ্বাস। লকডাউনে কলকারখানাগুলি বন্ধ, শ্রমিকের বেতন নিয়েও অনিশ্চয়তা। ভিন্ রাজ্যে আটকে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। বেশির ভাগ জায়গায় শ্রমিকেরা নিজেদের জমানো অর্থে অন্নের সংস্থান করছেন। কিছু এলাকায় মিলছে এক বেলার খাবার। পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে ঘরে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বহু শ্রমিক। শুধুমাত্র রাস্তা দিয়ে হেঁটে দূর-দূরান্ত থেকে নিজের বাড়ি ফিরতে গিয়ে মারা পড়ছে জামলো মকদমেরা। আরও সরকার শ্রমিকদের জীবনের অধিকার সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ।
‘মে দিবস’ এই প্রেক্ষিতে তাই আরও প্রাসঙ্গিক, আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার সময় এখন। এক জোট হয়ে শ্রমিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা চাওয়ার সময় এখন। তাঁদের শ্রমকে যেন আমরা সহজলভ্য ভেবে না নিই।