বাঁ দিকে, আনিসুরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রথম চিঠি। ডান দিকে, আমন্ত্রণ বাতিল হল। —নিজস্ব চিত্র
প্রথমে, সাদর আমন্ত্রণ। রাত পোহানোর আগেই পরের চিঠি— ‘দুঃখিত, অনুষ্ঠানে আপনার আসার প্রয়োজন নেই।’
সৌজন্য নুর্শিদাবাদ জেলা স্বাস্থ্য দফতর। প্রাপক: রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমান। মুখ্যমন্ত্রীর ‘সৌজন্যের’ বার্তায় ঢ্যারা কেটে দিয়ে সরকারি আমলারা বলছেন, ‘‘কী করব বলুন, শাসক দলের চাপ, বোঝেনই তো!’’
দুয়ারে নির্বাচন। কালীঘাটের ‘ক্লাসরুম’ থেকে দলীয় সভা— নেতা-কর্মীদের ক্রমাগত সৌজন্যের বার্তা দিয়ে চলেছেন দলনেত্রী। সে পাঠ নিয়ে জেলায় জেলায়, দলের শীর্ষ নেতারাও আওড়ে চলেছেন— এমন কিছু করবেন না যা মানুষের খারাপ লাগে, সৌজন্যের ঘাটতি যেন না হয়।
নবান্নে সিপিএম নেতাদের ফিশ ফ্রাইয়ের প্লেট এগিয়ে দেওয়া হোক কিংবা বিজেপি-র মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে গাড়িতে তুলে ঝালমুড়ি খাওয়ানো— পাঁচ বছরের শাসন কালে খোদ দলনেত্রীর সৌজন্য দেখানোর তালিকা অবশ্য দীর্ঘ নয়। তবে, ভটোরে মুখে দলের নেতা-কর্মীদের অনর্গল সহবত শেখানোর চেষ্টায় কোনও পাঁক রাখছেন না মমতা বন্দোপাধ্যায়।
সেই চেষ্টায় কালি ছিটিয়ে দেল মুর্শিদাবাদের স্বাস্থ্য দফতর।
দিন কয়েক আগেই প্রায় আড়াইসো কিলোমিটার দূর থেকে বোতাম টিপে ডোমকলের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের উদ্বোধন সেরে ফেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠানের আগের দিন স্থানীয় বাম বিধায়ক আনিসুরের কাছে চিঠিও পৌঁছে গিয়েছিল— অনুষ্ঠানে আপনি একান্ত স্বাগত। সমস্যাটা বেধেছিল তার পরেই।
দলীয় সূত্রে খবর, আনিসুরকে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে জানতে পেরে বেঁকে বসেছিলেন জেলা তৃমূলের এক যুব নেতা। দলের পক্ষে সেই এ বার ডোমকলে প্রার্থী তালিকায় সব চেয়ে জোরালো নাম। দিন কয়েক ধরে তাই বহরমপুরের বিলাসবহুল বসত ছেড়ে পড়েও রয়েছেন ডোমকলে। দলের এক জেলা নেতার কথায়, ‘‘আনিসুরের নাম দেখেই কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে পা বাড়ানো ওই যুব নেতা আস্ফালন শুরু করেন, ‘যাঁর সঙ্গে ভোটে লড়াই, তার সঙ্গেই এক মঞ্চে বসতে হবে, এটা হয় নাকি!’ ওই নেতার চাপেই আনিসুরের নাম বাদি দিতে বাধ্য হয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।’’
বাধ্য হয়েই পরের দিন আনিসুরের কাছে চিঠি পাঠান ওই হাসাপাতালের সুপার। তবে স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘স্বাস্থ্য দফতরের প্যাড নয়, আমাদের কাছ থেকে প্যাডের কপি নিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে তার একটা প্রতিলিপি ছাপিয়ে সেখানে নিমন্ত্রণ পত্র বাতিলের ওই চিঠি লিখতে বাধ্য করা হয়েছে। এর পরে আর চাকরি করার ইচ্ছে থাকে!’’
ওই অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক ডোমকমল মহকুমা হাসপাতালের সুপার প্রবীর মাণ্ডি অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘যা বলার মূখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভাসিষ সাহা বলবেন।’’ শুভাসিসবাবু বিষয়টা ঠেলছেন মহকুমা হাসপাতালের সুপারের কোর্টে। তার কথায়, ‘‘ওই অনুষ্ঠানের বিষয়টি মহকুমাস্তরে ঠিক হয়েছে, ওঁরাই বলতে পারবেন।’’
আনিসুর রহমান অবশ্য এ নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘এটাই তো এ রাজ্যের সংস্কৃতি হয়ে দাড়িয়েছে।’’ ঘনিষ্ঠদের কাছে তিনি অবশ্য জানান, শাসক দলের চাপেই যে পাল্টা চিঠি তা নিয়ে সংশয় নেই তাঁর।
জেলা সিপিএমের দাবি, নামেই সুপার স্পেশ্যালিটি ও ই হাসপাতাল যে আদতে তৃণমূলের সামনে ঘোর বিপদ ডেকে আনবে তা ভোটের সময়েই বোঝা যাবে। সিপিএমের ডোমকল জোনাল কমিটির সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমানের দাবি, ‘‘দুটি চিঠি পর পর দেখলেই পরিস্কার হবে এটা শাসক দলের তৈরী করা চিঠি, দুটি চিঠির লেটারহেড সম্পূর্ণ আলাদা। তা ছাড়া একটিতে সিল দেওয়া অন্যটিতে নেই।’’
শুক্রবার, ওই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন জেলাশাসক, স্বাস্থ্য অধিকর্তা, সকলেই। ছিলেন, তৃণমূলের জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন এবং যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক সৌমিক হোসেন। একটি সরকারী অনুষ্ঠানে দলীয় নেতারা কেন? রানিনগর বিধানসভার বিধায়ক কংগ্রেসের ফিরোজা বেগম বলেন, ‘‘এটা নতুন কোনও বিষয় নয়, কারণ এ রাজ্যে এটাই রীতি।’’
আর সৌমিক?
তিনি বলছেন, ‘‘স্বাস্থ্য দফতর কাকে আমন্ত্রণ করেছিল না করেছিল জানি না। আমাকে আর বাবাকে (মান্নান হোসেন) নিমন্ত্রণ করায় আমরা গিয়েছিলাম।’’
যা শুনে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন— তা হলে সকলের আমন্ত্রণ বাতিল হয়নি!