অঙ্কন: মণীশ মৈত্র
চেম্বারে থিকথিক করছে রোগীর ভিড়। ঠিক সেই সময়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকল লোকটা। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পরনে খেটো ধুতি, মলিন সাদা শার্ট।
কান থেকে স্টেথোস্কোপ সরিয়ে বেশ বিরক্তির সঙ্গেই ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কী হে, এত তাড়া কীসের? বাকিরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে!”
হাঁফাতে হাঁফাতে লোকটি তখন বলে চলেছে, “ও ডাক্তারবাবু, আমি কার্তিক। কার্তিক ঘোষ। চিনতে পারছেন না? আপনাদের গুরুদেবের আশ্রমে থাকি গো।”
এ বার তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন নবদ্বীপের ডাক্তারবাবু। উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলেন, “অ্যাঁ, কী হয়েছে ঠাকুরের?” অভয় দেয় লোকটি, “না না, ঠাকুরের কিছু হয়নি। তিনি শ্রীহরির কৃপায় ভালই আছেন। বিগড়েছে কেবল গাড়িটা।”
লোকটি আরও জানায়, পরের দিন গুরুদেব নবদ্বীপে আসছেন। প্রথমে ডাক্তারবাবুর বাড়িতেই উঠবেন। তার আগে গাড়ি বোঝাই করে সর্ষের তেল, গুড় ও চাল পাঠিয়েছিলেন। সে গাড়ি গিয়েছে মাঝরাস্তায় খারাপ হয়ে। তাই ছুটতে ছুটতে ডাক্তারবাবুর কাছে এসেছে।
ডাক্তার পড়লেন আতান্তরে। একে তো আগাম খবর না দিয়েই গুরুদেব আসছেন। তার চেয়েও বড় কথা, মাঝরাস্তায় গুরুদেবের গাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র পড়ে। তা দিয়েই ভোগ রান্না হওয়ার কথা। তা হলে উপায়?
ভাবতে ভাবতে বারান্দায় পায়চারি করছেন ডাক্তারবাবু। মুশকিল আসান করে দিল কার্তিক নামে লোকটাই— “আপনি অত ভাববেন না। বেশি দূরে তো নয়, নিমতলায় বিগড়েছে গাড়ি। মিস্ত্রিকে ডাকা হয়েছে। মেরামতিও এতক্ষণে বোধহয় শুরু হয়ে গিয়েছে। গাড়ি সারানোর জন্য কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিলেই হবে।”
হ্যাঁ, সে আর কঠিন কী!
ডাক্তারবাবু দেরাজ থেকে খান কয়েক একশো আর পঞ্চাশের নোট বের লোকটার হাতে করে দেন। মলিন শার্টের বুকপকেটে সেগুলো গুঁজে সে চিন্তিত মুখে বলে, “অন্য জিনিস নিয়ে তো সমস্যা নেই। চিন্তা শুধু ওই তেল আর গুড় নিয়েই। কয়েকটা পাত্র হলে ওগুলো আগে নিয়ে আসতে পারি। গাড়ি ঠিক হলে তার পরে নয় চাল-ডাল তাতেই আসবে।”
গুরুদেবের ব্যাপার! ডাক্তারবাবু কি আর না বলতে পারেন? লোকটা এর মধ্যে মনে করিয়ে দেয়, “পাত্র আবার কাঁসা-পেতলের দিতে হবে। ওই তেল দিয়েই পরের দিন ঠাকুরের ভোগ রান্না হবে কি না।”
এ বার ডাক্তারবাবু একটু বিরক্তই হন, “এ সব কি তোমায় আমাকে মনে করাতে হবে! গুরুদেব কি আমার বাড়িতে এই প্রথম আসছেন নাকি!” ডাক্তারবাবু লোকটিকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকেন। সে নিজেই পিতলের বড় হাঁড়ি-কলসি বেছে নেয়। যাওয়ার আগে তাকে পেট ভরে জলখাবারও খাইয়ে দেন ডাক্তারবাবু।
কিন্তু, এতটা পথ অতগুলো হাঁড়ি-কলসি নিয়ে লোকটা যাবে কী করে! ভেবেচিন্তে একটা ভ্যানরিকশা ভাড়া করে দেন ডাক্তারবাবু। দুগ্গা-দুগ্গা বলে লোকটি টাকা আর বাসনপত্র নিয়ে রওনা দেয়। নবদ্বীপ থেকে নিমতলা কয়েক ঘণ্টার
রাস্তা! কিন্তু বেলা গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে রাত। সে লোক আর ফেরে না।
এ বার সন্দেহ হয় ডাক্তারবাবুর। ফোন করেন নবদ্বীপেরই আর এক গুরুভাইকে। তিনি এলাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সব শুনে ফোনের ও প্রান্তে প্রায় লাফিয়ে ওঠেন তিনি, “বলো কী? এই একই গল্প বলে আমার বাড়ি থেকেও তো টাকা আর বাসনকোসন নিয়ে গেল লোকটা। নামটা কী যেন? হ্যাঁ, কার্তিক!”
নামে কি-ই বা এসে যায়!
কার্তিক হোক বা বাবন— আসলে পুঁজি তো মগজে ঠাসা কুটকুটে বুদ্ধি আর ইস্পাতের মতো শীতল স্নায়ু। যেমন বেলডাঙা মণ্ডলপাড়ায় পিচের রাস্তা থেকে নেমে নলকূপের পাশ দিয়ে যে ছেলেটা হেঁটে যাচ্ছে, একটু পরেই সে তার নাম বলবে বাবাই।
নলকূপ বাঁ হাতে রেখে গলি ধরে শ’খানেক মিটার এগোলেই বিজন মণ্ডলের বাড়ি। সকাল ৯টা নাগাদ সে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল ছেলেটা। হাতে ঝুলছে নধর একখান ইলিশ। বাড়ির গিন্নি দরজা খুলতেই ছেলেটা একগাল হেসে বলল, “এই যে বৌদি, আপনি আমায় চিনবেন না। আমার নাম বাবন। বিজনদা বাজার থেকে ইলিশটা পাঠাল। আর বলল, বাড়ি থেকে ওঁর সাইকেলটা নিয়ে যেতে। কোথাও যাবে বোধহয়।”
বিশ্বাস বড় বিষম বস্তু!
“এ ইলিশ পদ্মার না হয়ে যায় না!” ভাবতে-ভাবতে বিজনবাবুর স্ত্রী সাইকেলের চাবি দিলেন বাবনের হাতে। দুপুরে বিজনবাবু যে হেঁটে বাড়ি ফিরলেন, খেয়াল করেননি গিন্নি। স্নান সেরে খেতে বসে কত্তা তো আহ্লাদে আটখানা। বাঁশকাঠি চালের ভাত আর সর্ষে দিয়ে ভাপানো ইলিশ! এক গ্রাস ভাত আর এক টুকরো ইলিশ ভাপা মুখে পুরে বিজনবাবু গিন্নিকে বললেন, “তোমার বাবার কিন্তু জুড়ি নেই, যাই বলো। জামাই কী খেতে ভালবাসে, সেটা উনি বছরভর মনে রাখেন। তা, ইলিশ তিনি কখন পাঠালেন?”
গিন্নি অবাক, “এ আবার কেমন মশকরা! তুমি নিজেই তো বাবাই বলে একটা ছেলের হাত দিয়ে মাছ পাঠিয়ে সাইকেল নিয়ে যেতে বলেছিলে।’’ ‘আমি?’ বলেই বিজনবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, উঠোনে যেখানে সাইকেল দাঁড় করানো থাকে, সেখানটা ফাঁকা।
গলায় ভাত আটকে গেল। ভাপা ইলিশও যে এত বিস্বাদ হতে পারে, বিজনবাবুর জানা ছিল না!