প্রতীকী ছবি।
বছরভর তার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকে বঙ্গভূম। তাকে ছাড়া খেজুর রসে ‘তাড়’ আসে না। গন্ধহীন থাকে নলেন। কমলালেবু বিস্বাদ। তাকে পাশে পেলেই হিম সকালে রোদের ওম চায় লোভী শরীর। বাঙালির সে বড় কাঙ্খিত শীত!
ডিসেম্বর মাঝামাঝি থেকে সে জানান দিয়েছে তার উপস্থিতি। সকলেই যখন এবার প্রবল শীত পড়া নিয়ে প্রায় নিশ্চিন্ত তখন ভরা পৌষে হঠাৎ করেই তিনি দুষ্টু লোকের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেলেন!
নেই তো নেই! চড়চড়িয়ে উঠতে শুরু করেছে পারদ। শোনা যাচ্ছে, গত এক দশকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে উষ্ণতার এই বাড়াবাড়ি দেখা যায়নি। দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ডিগ্রি উঁচুতে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪-৫ ডিগ্রি বেশি। রোদ পোহানো দূর, আঁচে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। জ্যাকেট, টুপি, সোয়েটার খুলে ফেলতে হচ্ছে। মুখঢাকা মাস্কের কথা অআর না-ই বা তোলা গেল। হাঁসফাঁস পর্যটকদের দেখে জলঙ্গি পাড়ের ভিখারি বাউল দোতারায় গান ধরেছেন— “ও আমি কোথায় পাবো তারে…!”
বিগত এক দশকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এত উষ্ণতা দেখা যায়নি বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। কৃষিবিদ থেকে চিকিৎসকদের কপালে ভাঁজ। অসময়ে এমন তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানুষ বা মরশুমি ফসল, কারও পক্ষেই স্বাস্থ্যকর নয়।
এই প্রসঙ্গে সরকারি কৃষিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, “সাধারণ ভাবে এই সময়ে গড় তাপমাত্রা নীচে ৯-১১ ডিগ্রি এবং ঊর্ধ্বে ২৫-২৬ ডিগ্রি থাকার কথা। কোনও কোনও বছর তা আরও কম থাকে। কিন্তু এবারের চিত্র অনেকটাই অস্বাভাবিক। যদি এমনটাই চলতে থাকে এর প্রভাব ফসলে পড়বে।” কৃষি আবহাওয়াবিদেরা জানাচ্ছেন, গত দিন তিনেক ধরে হাওয়ার গতিপথও কিছুটা বদলে গিয়েছে। এই সময় পাহাড় ছুঁয়ে বরফ শীতল হওয়া আসে বলেই কনকনে শীত পড়ে। দিন আর রাতের তাপমাত্রার মধ্যে ফারাক হু হু করে বাড়তে থাকে। কিন্ত এখন হাওয়া বইছে কিছুটা পূর্ব-দক্ষিণ দিক থেকে। ফলে সেই শীতলতা অন্তর্হিত হয়েছে।
নতুন বছরের শুরু থেকেই শীত হারানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের ছাত্র জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী জোর দিচ্ছেন পশ্চিমি ঝঞ্ঝার ওপর। তাঁর কথায়, “ভূগোলের পরিভাষায় পশ্চিমি ঝঞ্ঝা বলতে, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে আসা জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু বা ‘জেট বায়ু’র প্রভাবে কর্কটক্রান্তি রেখার ওপরে থাকা দেশগুলি— মূলত ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতের পশ্চিম ভাগ, মধ্যভাগ ও গাঙ্গেয় সমভূমি জুড়ে মেঘাচ্ছন্নতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে স্থান বিশেষে বৃষ্টিপাত এবং হঠাৎ উষ্ণতার বৃদ্ধি দেখা যায়। এ বছর জেট বায়ু অত্যাধিক সক্রিয় থাকার জন্য ভারতের পশ্চিম দিক থেকে আসা জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু পশ্চিম হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কর্কটক্রান্তি রেখার উত্তর ভাগের এলাকাগুলিতে মেঘাচ্ছন্নতার সৃষ্টি করেছে। নদিয়ার উপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা যাওয়ায় আবহাওয়ার এই হঠাৎ পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে এখানে।”
আবহাওয়া রেকর্ড বলছে, বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারি নবদ্বীপ-মায়াপুর ও সংলগ্ন এলাকায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ২৯ ডিগ্রি ও ১৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যা বিগত দশ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড তাপমাত্রা। অন্যদিকে ২০১৮ সালে এই দিনে তাপমাত্রা ছিল সবচেয়ে কম সর্বোচ্চ ২০ ডিগ্রি এবং সর্বনিম্ন ৮ ডিগ্রি। আবহাওয়া দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৮ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত নদিয়ার আকাশে মেঘাচ্ছন্ন ভাব থাকবে। ফলে দিনের বেলায় উষ্ণতা বাড়বে। যদিও সন্ধ্যার দিকে পারদ নিম্নমুখী হবে। আগামী ১৯ জানুয়ারি নাগাদ ওই মেঘাচ্ছন্ন ভাব কাটার সঙ্গে নিজের ছন্দে ফিরতে পারে শীত।