‘হাড় হিম করা জলে হাবুডুবু খেতে খেতে বাসের বাইরে এলাম’

আচমকা একটা বিকট শব্দ। চারপাশে কান্না, চিৎকার। হাড় হিম করা জলে হাবুডুবু খেতে খেতে কী ভাবে বাসের বাইরে এসেছি, সাঁতার না জানার পরেও কী ভাবে পাড়ে এলাম, আজও আমি জানি না। মনে হয়, বরাত জোরেই বেঁচে গিয়েছি।

Advertisement

পরিমল মণ্ডল

ডোমকল শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:১৩
Share:

শীতের রাত। লালবাগ যুব আবাসের বড় ঘরে কেউ শেষ রাতে একটু ঘুমিয়েছিল, কেউ আবার না ঘুমিয়ে আড্ডায় মজেছিল। আমার ছেলেবেলার বন্ধু আরেজুল ইসলাম রোজা রাখবে শুনে তার খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন সনাতন স্যর। তার খাওয়া শেষ হতেই আমরা আর অপেক্ষা করিনি। সকাল সকাল বাড়ি ফিরব ভেবে একে একে বাসে উঠলাম সকলেই। বাস ছাড়ার পরে সকলেই ঘুমিয়ে কাদা। গর্তে চাকা পড়লেই ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম, ঘন কুয়াশায় মোড়া রাস্তায় ধীরে ধীরেই চলছে আমাদের বাস। তার পরে ফের ঘুম।

Advertisement

আচমকা একটা বিকট শব্দ। চারপাশে কান্না, চিৎকার। হাড় হিম করা জলে হাবুডুবু খেতে খেতে কী ভাবে বাসের বাইরে এসেছি, সাঁতার না জানার পরেও কী ভাবে পাড়ে এলাম, আজও আমি জানি না। মনে হয়, বরাত জোরেই বেঁচে গিয়েছি।

পাড়ে উঠতেই এক প্রৌঢ়া আমার হাত ধরে পাড় লাগোয়া একটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন। চাদর জড়িয়ে দিলেন গায়ে। তখন বাড়িতে আরও জনা কয়েক মহিলা হাজির হয়েছেন। কেউ আগুন জ্বেলে দিলেন, কেউ আবার একটু তেল এনে মাখিয়ে দিলেন হাতে পায়ে। একটু পরে এক গ্লাস গরম দুধ এনে দিলেন আরও এক জন।

Advertisement

আমি তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। সনাতন স্যরের কোচিংয়ে পড়াতাম। সেখান থেকেই সকলে লালবাগে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম। পদ্মা পাড়ের বাড়িতে একটু ধাতস্থ হয়ে জানতে চাইলাম, বাকিদের কী খবর? তারা কি সকলে বাস থেকে বেরিয়ে পাড়ে উঠতে পেরেছে? সকলেই আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন—‘সবাই ঠিক আছে।
ভাল আছে।’

১৯৯৮ সালের ১৪ জানুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

কিন্তু তাঁদের কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না। পদ্মাপাড় থেকে ভেসে আসছিল লোকজনের কান্না। তখনও বুঝিনি আমার ছেলেবেলার বন্ধু আরেজুল ইসলাম আর নেই। নেই আরও অনেকে। কুয়াশা মুছে সূর্য উঠল। কিন্তু আমার ৬২ জন বন্ধু আর দু’জন শিক্ষক সেই আলো দেখতে পেলেন না।

১৩ জানুয়ারি, ১৯৯৮। আমার জীবনের ভয়ঙ্কর একটা দিন। এখনও মাঝেমধ্যে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। চমকে উঠি। দেখতে দেখতে ২১টা বছর পেরিয়ে গেল। এখনও চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখগুলো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement