আক্ষরিক অর্থেই এ যেন চোর-পুলিশ খেলা। হাজার কড়াকড়ি, আচমকা টহল, কড়া সতর্কতা সত্ত্বেও চাঁদার জুলুম যে কমেনি তা মালুম হল কালীপুজোর দিনও। গলিপথ দূরের কথা, শনিবার খোদ রাজপথ থেকেই গ্রেফতার করা হল চাঁদা আদায়কারীদের। শুধু মাত্র রানাঘাটেই যার সংখ্যা ১১।
পুলিশ যখন শব্দদানব ঠেকাতে ঢাল-তরোয়াল নিয়ে ময়দান দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর তারই ফাঁক গলে বহাল তবিয়তে খেল দেখাচ্ছে চাঁদা আদায়কারীরা। বাধা পেলে মারধর করতেও পিছপা হচ্ছে না তারা।
বদলে যাচ্ছে শুধু জায়গার নাম। কখনও রানাঘাট, তো কখনও নাকাশিপাড়া, কখনও বহরমপুর বা রঘুনাথগঞ্জ। গত কয়েক দিনে নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদে পুলিশ বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করলেও এখনও অধরা অনেকেই। কার্যত চোরাগোপ্তা চাঁদা আদায় চালিয়েই গিয়েছে তারা, এখনও যাচ্ছে।
মুর্শিদাবাদে চোরাগোপ্তা খেল যেন একটু বেশিই। ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয়ে যায় ক্লাবের দামালদের দৌরাত্ম্য। বহরমপুর শহর লাগোয়া চুঁয়াপুর রেলগেটের সামনে লাঠি-বাঁশ হাতে দাঁড়িয়ে যায় ওরা। রাতের দিকেই দূরপাল্লার বাস-লরির ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে বেশি চলে। কখনও রঘুনাথগঞ্জ, কখনও বা বহরমপুরে এই সময়ে চাঁদার জুলুম বেশি হয় বলে অভিযোগ লরির চালকদের। সারা রাত টহলের পরে ভোরের দিকে পুলিশও রাস্তায় থাকে না। সেই সুযোগ কাজে লাগায় চাঁদা তোলার দল। গাঁট কাঁটা যায় লরি-বাসের মালিকদের।
রাস্তা আটকে জোর করে কালী পুজোর চাঁদা আদায়, দাবি মতো চাঁদা না পেয়ে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। তবে মুর্শিদাবাদের সঙ্গে ফারাক হল, এখানে কিছু ধরপাকড় হচ্ছে। গত ১৫ দিনে চাঁদার জুলুমের অভিযোগে নদিয়ায় অন্তত ৭১ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। শুক্রবার পর্যন্ত সংখ্যাটা ছিল ৫৭। এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আরও ১৪ জনকে পাকড়াও করা হয়েছে। পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া বলেন, “চাঁদা তোলা নিয়ে জোরাজুরি নজরে এলেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। জুলুমের অভিযোগ পেলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তোলার অভিযোগে এ দিন শুধু রানাঘাট থেকেই বিভিন্ন ক্লাবের ১১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সকালে স্থানীয় কলাবাগান এলাকায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাদের রানাঘাট আদালতে তোলা হলে জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
নদিয়া জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, ১৫ অক্টোবর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত রানাঘাট, হরিণঘাটা, কল্যাণী থেকে শুরু করে শান্তিপুর, করিমপুর, তেহট্ট, নাকাশিপাড়া মিলিয়ে মোট ৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সকালে রানাঘাটের কলাবাগানে জোর করে জাতীয় সড়কে চাঁদা তোলার খবর পেয়ে পুলিশ যায়। হাতেনাতে ধরা পড়ে ১১ জন। বিকালে আবার তেহট্টের দেবনাথপুরে কৃষ্ণনগর-করিমপুর রাজ্য সড়ক আটকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করে। সেখানে রাস্তা আটকে চাঁদা আদায় করছিল স্থানীয় একটি ক্লাবের সদস্যেরা। গাড়ি চালকদের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাদের ধরে। কালীপুজোর চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে গত পনেরো দিনে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে নাকাশিপাড়া এলাকার জালসুখায়। শুক্রবার সকালে সেখানে স্থানীয় একটি ক্লাবের সদস্যেরা চাঁদা তুলছিল। বেথুয়াডহরি থেকে বীরপুর যাওয়া একটি লরি আটকে তারা চাঁদা চায়। চাঁদার অঙ্ক নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। অভিযোগ, ওই সময়ে লরি চালক এবং লরির এক যাত্রীকে বেধড়ক মারধর করে ক্লাবের সদস্যেরা, সঙ্গে ছিল প্যান্ডেল বাঁধার লোকজনও। লরির এক যাত্রীর মাথা ফেটে যায়। ওই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে সুকুমার শীল নামে এক প্যান্ডেলকর্মী শুক্রবারই গ্রেফতার করেছিল নাকাশিপাড়া থানার পুলিশ। শনিবার কৃষ্ণনগর আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে ১৪ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। চাঁদার জুলুমের অভিযোগে বৃহস্পতিবার শান্তিপুরের ঘোষপাড়ার একটি ক্লাবের সভাপতি এবং এক সদস্যকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
অন্তত নদিয়ায় যে পুলিশ কিছুটা সক্রিয় হয়েছে তা মানছেন ভুক্তভোগী চালক ও যাত্রীরা। তবে এই সক্রিয়তা এত ঢিমে তালে শুরু হল কেন, সেই প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।