গৌতম মণ্ডল। ফাইল চিত্র
ভ্রুকুটি ছিল ফণীর। তা উপেক্ষা করেই কাজে গিয়েছিলেন বাড়ির একমাত্র রোজগেরে প্রতিবন্ধী যুবক। বিকেলে ফেরার পথে বারাসত স্টেশনে এসে দেখেন, ট্রেন চলছে না ঠিক মতো। বাতিল হয়েছে বেশ কিছু ট্রেন। চলছে যাত্রী বিক্ষোভ ও ভাঙচুর। সেই বিক্ষোভে ‘শামিল’ থাকার অভিযোগে রেল পুলিশ গত শুক্রবার ধরে নিয়ে যায় ওই প্রতিবন্ধী যুবককে। সেখান থেকে ঠাঁই হয় দমদম সেন্ট্রাল জেলে। মঙ্গলবার রাতে দেগঙ্গা থানার পুলিশ পদ্মপুকুরে চাতরা-বটতলার বাড়িতে গিয়ে খবর দেয়, গৌতম মণ্ডল (৩০) নামে ওই যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
গৌতমের স্ত্রী সপ্তমী ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। খবরটা জেনে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। কোনও মতে বললেন, ‘‘বারাসতের রেল পুলিশ আটকে রেখেছে জানতে পেরে পর দিনই সকলে গিয়ে পুলিশকে জানায়, ও প্রতিবন্ধী। ভাঙচুর করার ক্ষমতাই ওর নেই। ছেড়ে দিন। কিন্তু পুলিশ শোনেনি।’’ গৌতমের মা আরতি মণ্ডল বললেন, ‘‘প্রতিবন্ধী ছেলেটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে, খেতে না দিয়ে মারধর করে মেরে ফেলা হয়েছে। ও কোনও ঝামেলায় থাকত না। যারা ওকে এ ভাবে মেরে ফেলল, তাদের কঠিন শাস্তি চাই।’’
এলাকার ক্ষুব্ধ মানুষেরও দাবি, সুস্থ অবস্থায় গৌতমকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর জেল হেফাজতে কী করে তাঁর মৃত্যু হল, এর তদন্ত চাই। তা না হলে, মৃতদেহ নিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন তাঁরা। বুধবার আরজি কর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত না-হওয়ায় মৃতদেহ হাতে পায়নি পরিবার। থানায় গিয়ে জেল হেফাজতে এই মৃত্যুর তদন্ত চেয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন সপ্তমীদেবী। দমদম সেন্ট্রাল জেলের সুপার দেবাশিস চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘প্রয়োজনীয় বিচার বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে।’’
তবে কারা দফতর সুত্রে আরও জানা গিয়েছে, ৪ মে, শনিবার সন্ধেয় যখন গৌতমকে জেলে আনা হয়, তখন তাঁর শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল। এমনিতেই পায়ে সমস্যা ছিল। সেখানেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। জেলে এই ক’দিন তাঁকে নিয়মিত চিকিৎসক দেখছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে পরিস্থিতির অবনতি হলে তাঁকে আরজি কর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
গৌতমের মায়ের অভিযোগ, সোমবার দমদম সেন্ট্রাল জেলে দেখা করতে গেলে অন্য কয়েদিদের মতো গৌতমকে সামনে না-এনে দূর থেকে দেখানো হয়। তিনি কাকুতি-মিনতি করলেও ছেলেকে সামনে আনা হয়নি। এমনিতেই গৌতমের একটি পা দুর্বল। তখন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। টলে টলে পড়ে যাচ্ছিলেন। আরতিদেবীর কথায়, ‘‘দূর থেকেই চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে গৌতম বলছিল, আমাকে পুলিশ খুব মারধর করছে, খেতে দেয়নি।
আমি বিক্ষোভে ছিলাম না। অনেক ক্ষণ ট্রেন বন্ধ থাকার পর হঠাৎকরে ছেড়ে দেওয়ায় আমি উঠতে পারিনি।’’
গত ৩ মে বিকেলে ফণীর আশঙ্কায় বেশ কিছু ট্রেন বাতিল করেছিল পূর্ব রেল। তার জেরে বারাসত-হাসনাবাদ, বারাসত-বনগাঁ শাখায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তা নিয়ে ক্ষোভ দেখান অফিস ফেরত যাত্রীরা। ভাঙচুর হয় বারাসত স্টেশনে।
লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে হয় রেল পুলিশকে। গ্রেফতার হয় কয়েক জন। তার মধ্যে ছিলেন গৌতমও। শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার অশেষ বিশ্বাসকে তাঁর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘যারা ভাঙচুর চালিয়েছে তাদের ৩ মে গ্রেফতারের পর ডাক্তারি পরীক্ষা করে পর দিন আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে জেলে যাওয়ার পর এত দিন পরে কিছু হয়ে থাকলে বলতে পারব না।’’
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৭ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর একমাত্র সন্তান গৌতমের উপর দায়িত্ব পড়ে মা ও দুই বোন-সহ গোটা সংসারের। ছোটবেলা থেকে প্রতিবন্ধী গৌতমের ডান পা দুর্বল ছিল। সংসার চালাতে তিনি নীলগঞ্জের একটি ছাপাখানায় কাজ করতেন। সেখান থেকেই বাড়ি ফিরতে চেয়ে পৌঁছে গেলেন মর্গে! কিন্তু কেন? জানতে আকুল অন্তঃসত্ত্বা সপ্তমী।