বহাল চাপান-উতোর

রাজনৈতিক তরজায় তপ্ত শিলিগুড়ি, আজ পুরবোর্ড গঠন

পুরবোর্ড গঠনের ২৪ ঘণ্টা আগে ঘোড়া কেনাবেচার চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে শিলিগুড়িতে তৃণমূলের ঘরে-বাইরে বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে। বাম নেতারা নিজেদের সব কাউন্সিলরকে ‘সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে’ রাখায় সেখানে ভাঙনের আশাও ক্ষীণ। কংগ্রেস ও বিজেপি শিবিরের কাউন্সিলররা বাম-তৃণমূল উভয়ের থেকে সমদূরত্ব রাখার কথা সরকারি ভাবে ঘোষণা করেছেন।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৫ ০৪:১৫
Share:

শিলিগুড়ির পুরবোর্ড গঠনের আগে পুরভবনে সাজছে ভাবী মেয়রের গাড়ি। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

পুরবোর্ড গঠনের ২৪ ঘণ্টা আগে ঘোড়া কেনাবেচার চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে শিলিগুড়িতে তৃণমূলের ঘরে-বাইরে বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে। বাম নেতারা নিজেদের সব কাউন্সিলরকে ‘সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে’ রাখায় সেখানে ভাঙনের আশাও ক্ষীণ। কংগ্রেস ও বিজেপি শিবিরের কাউন্সিলররা বাম-তৃণমূল উভয়ের থেকে সমদূরত্ব রাখার কথা সরকারি ভাবে ঘোষণা করেছেন। লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসেবে বিস্তর ‘ডন-বৈঠক’ দিয়েও শিলিগুড়ি পুরসভার ভোটের ২৪ ঘণ্টা আগে যেন রণে ভঙ্গ দিলেন তৃণমূলের মেয়র পদের দাবিদার নান্টু পাল। এর মধ্যেই রবিবার শহরের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে গোলমালের জেরে উত্তেজনা ছড়ায়। সব মিলিয়ে আজ, সোমবার পুরবোর্ড গঠনের আগে তেতে উঠেছে শিলিগুড়ি।

Advertisement

রবিবার দুপুরে নিজের ওয়ার্ডের দলীয় অফিসে বসে নান্টুবাবু বললেন, ‘‘ঘোড়া কেনাবেচার চেষ্টা কোথায় করলাম! অহেতুক বিতর্ক হচ্ছে। তবে সুযোগ পেলে অন্য দলের কাউন্সিলরদেরও সমর্থন চাইব। তাঁরা ভোট দিলে ভাল। জয়-পরাজয়, দুই-এর জন্যই আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত। হারলেও পুরসভায় বসেই শহরের উন্নয়নের যে কাজ রাজ্য সরকার শুরু করেছে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখব।’’ হাতে মাত্র ১৭ জন কাউন্সিলর। বামেরা ২৩ জন। তাদের সঙ্গে রয়েছেন নির্দল কাউন্সিলর অরবিন্দ ঘোষ ওরফে অমুবাবু। ফলে, সব ঠিকঠাক থাকলে বামেরাই বোর্ড গড়ার মুখ্য দাবিদার। কংগ্রেসের চার জন ও বিজেপির দুজনের সমর্থন পেলেও নান্টুবাবুর মেয়র হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না। কংগ্রেস-বিজেপি শিবিরের কয়েক জন কাউন্সিলর একান্তে জানিয়েছেন, নানা প্রস্তাব পেলেও তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকী, কংগ্রেসের কাউন্সিলর সুজয় ঘটক, পিন্টু ঘোষ, সীমা সাহা, স্বপ্না দত্তরা রবিবারই ঘোষণা করেছেন, তাঁরা তৃণমূল-বাম কোনও পক্ষকেই সমর্থন করবেন না। একই ভাবে বিজেপি দু’জনও তা-ই জানিয়েছেন। শেষ মুহূর্তে কোনও গোলমাল না হলে কংগ্রেস-বিজেপির ৬ জন শপথ গ্রহণের পরে সভাকক্ষ ত্যাগ করবেন বলেই দলীয় সূত্রে দাবি করা হয়েছে। সে কারণেই নান্টুবাবুর মুখে হার স্বীকারের সুর বলে বিরোধীদের দাবি।

এর মধ্যেই রবিবারের গোলমালের জেরে দু’পক্ষের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে হামলার ঘটনায় জখম হয়েছেন তিন জন। নেপাল হক নামে এক তৃণমূল সমর্থককে গত শনিবার রাতে টাউন স্টেশন লাগোয়া এলাকায় মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এর পরে এ দিন দুপুরে সাত জনের একটি দুষ্কৃতী দল বাড়িতে ঢুকে নেপালের উপর চড়াও হয়ে তাঁর মাথায় ধারাল অস্ত্রের কোপ মারে বলে অভিযোগ। নেপালের মা রাজিয়া বিবিকেও বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ হয়েছে। দু’জনকেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। গৌতমবাবুর অভিযোগ, ‘‘সিপিএমের মদতে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে গুন্ডারাজ চলছে। রবিবারও আমাদের কর্মীদের খুনের চেষ্টা হয়েছে। তার প্রতিবাদে এলাকায় প্ররোচনা রুখতে শান্তি মিছিল করেছি।’’

Advertisement

বামেদের মেয়র পদের দাবিদার প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘‘দুই দুষ্কৃতী দলের মধ্যে গোলমালের ঘটনাকে রাজনৈতিক রং দিতে চাইছে তৃণমূল। বোর্ড গঠনের আগের দিন পুলিশ-প্রশাসনের উপর চাপ তৈরি করে আমাদের কাউন্সিলরদের ভয় দেখাতে চাইছে তৃণমূল।’’ এই পরিস্থিতিতে ‘সতর্ক’ বামেরা। বাম শিবিরের অধিকাংশ কাউন্সিলরই ‘পুর-উন্নয়ন বিষয়ক কর্মশালার’ জন্য প্রায় দিনরাত দলের অফিসেই থাকছেন। বাম কাউন্সিলরদের মধ্যে অশোক ভট্টাচার্য ছাড়া বাকিরা বেশির ভাগই কারও ফোন ধরছেন না।

সাবধানতার আরেকটা কারণ অবশ্য নান্টুবাবুও। বাম শিবিরের প্রায় সকলেই নান্টুবাবুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আর পাঁচটা দলের চেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল। কারণ, রাজনৈতিক জীবনে সিপিএমেই সব চেয়ে বেশি সময় কেটেছে তাঁর। প্রয়াত ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ভাবশিষ্য হিসেবে দলে পরিচিত ছিলেন নান্টু। তাঁর মতোই যে কোনও কঠিন কাজ হাসিলের জন্য তলব পড়ত নান্টুর। তাই নান্টুবাবুর গলায় হার স্বীকারের সুর কি ‘ফাইনাল’-এর আগে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার কোনও ছক? হাসলেন নান্টু। পাশে বসা স্ত্রী মঞ্জুশ্রীকে নিজের মোবাইলে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসা এসএমএস দেখানো থামিয়ে তৃণমূলের মেয়র পদের দাবিদার বললেন, ‘‘গোপন ব্যালটে ভোট হবে। সে জন্য সকলের কাছেই ভোট চাইব। অঘটনও তো ঘটতে পারে।’’

সে জন্যই অতি মাত্রায় সতর্ক বামেদের মেয়র পদের দাবিদার অশোকবাবু। তিনি বললেন, ‘‘নান্টু হারলেও পুরসভার কাজ করবেন বলে থাকলে সেটা ভাল ব্যাপার। তাতে বাস্তবকে মেনে নেওয়া হবে। কারণ, জনতার রায়কে অগ্রাহ্য করে জবরদস্তি কিছু হাসিলের চেষ্টা করলে শিলিগুড়ি বরদাস্ত করবে না।’’ এর পরেই অশোকবাবুর সংযোজন, ‘‘আমাদের কাছে আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। তাই কাউন্সিলরদের নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে কেউ তাঁদের বিপদে ফেলতে না পারে। মিথ্যে মামলায় ফাঁসাতে না-পারে। এতে কারও প্রতি আস্থা নেই ভাবাটা একেবারেই ভুল হবে।’’ যা শোনার পরে তৃণমূলের মেয়র পদের দাবিদারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘তৃণমূল মানুষকে বিপদ থেকে বাঁচায়। বিপদে ফেলার রাজনীতি করে না।’’

অর্থাৎ বাম শিবিরে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা কিন্তু নান্টু চালিয়ে যাচ্ছেন। কাজেই নান্টু সত্যিই রণে ভঙ্গ দিয়েছেন নাকি পরাজয় মেনে নেওয়ার মনোভাব দেখানোটা যুদ্ধের কৌশল, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায় শিলিগুড়ি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement