ফুরফুরা শরিফে মুকুল রায়। শনিবার রাতে সেখানে গিয়ে তিনি ঘণ্টাখানেক কথা বলেন পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির সঙ্গে। ছবি: দীপঙ্কর দে
মুখে বলছেন, তিনি দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু দলনেত্রীর সংস্রব এড়িয়ে চলছেন!
কালীঘাট পাড়া মাড়াচ্ছেন না। কিন্তু সময় বের করে বাংলার রঞ্জি ম্যাচ দেখতে চলে যাচ্ছেন!
তৃণমূলে এখন মূর্তিমান রহস্যের নাম মুকুল রায়! নিজের অবস্থান সম্পর্কে লুকোচুরি খেলে রবিবারেও যিনি জিইয়ে রাখলেন জল্পনা। বিরোধীরা কটাক্ষ করতে শুরু করেছেন, বিজেপির সঙ্গে বোধহয় রফা হয়ে গেল! বিজেপি দাবি করছে, নৈব নৈব চ! আর স্বয়ং মুকুল তাঁর রহস্যময় পদক্ষেপে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি দলে আছেন। আবার যেন নেইও! তৃণমূলের এক তরুণ নেতার কথায়, “দাদার খেলা এখন মেঘের আড়াল থেকে!”
অন্য রবিবারের মতো এ দিন কালীঘাটে তৃণমূল নেত্রীর বাড়িতে ঘরোয়া আসর ছিল না। যে হেতু শনিবারই সেখানে দলীয় বৈঠক হয়ে গিয়েছে, এ দিন আর ঘরোয়া বৈঠকের আয়োজন হয়নি। তাই সেখানে মুকুলের যাওয়ার প্রশ্নও নেই। কিন্তু রবিবার সকালে কালীঘাটের মিলন সঙ্ঘে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের জন্য আম দরবার বসে। কলকাতায় থাকলে দলের রাজ্য সভাপতি এবং স্থানীয় সাংসদ সুব্রত বক্সীর সঙ্গে সেই আসরে মুকুলও যান নিয়মিত। কিন্তু এ দিন সে দিকে যাননি। এমনকী তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, এ দিন কালীঘাটের বাড়িতে আসার জন্য দলনেত্রীর তরফে আলাদা বার্তা ছিল মুকুলের জন্য। কিন্তু তিনি কালীঘাট-মুখোই হননি! স্বভাবতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুকুলের দূরত্ব নিয়ে জল্পনা বাড়ছে!
মুকুল-শিবির অবশ্য বলছে, এ সব নেহাতই জল্পনা! দলনেত্রীর সঙ্গে এ দিন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষাতের কোনও সূচিই ছিল না। হুগলির ফুরফুরা শরিফ থেকে রাত আড়াইটের পরে ফিরে সকালে নিজাম প্যালেসের ঠিকানায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মুকুল। মিলন সঙ্ঘের আম দরবারে না যাওয়ার কারণ সেটাই। দিনের বেশির ভাগ সময়টাই তাঁর এ দিন কেটেছে নিজাম প্যালেসে। সেখানে আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য-সহ অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। আবার সন্ধ্যায় নিজাম প্যালেসে গিয়ে তাঁর দেখা পাননি আর এক মন্ত্রী রচপাল সিংহ! কারণ, মুকুল তখন সেখানে ছিলেন না!
এমন রহস্যময়তা প্রশ্ন উস্কে দিতে বাধ্য! প্রশ্ন তাই উঠেওছে দলের সঙ্গে সম্পর্কে কি টান ধরেছে? নিজাম প্যালেসে দিন কাটানোর ফাঁকে রবিবার এই প্রশ্নে রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করেছেন মুকুল। তাঁর পাল্টা ঝাঁঝালো মন্তব্য, “এ সব কথা আসছে কেন? আমি তৃণমূলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণসম্পাদক। সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হবে? দলের সঙ্গে যেমন যুক্তছিলাম, তেমনই আছি!” তাঁর অভিযোগ, সংবাদমাধ্যম বাইরে থেকে দল সম্পর্কে নানা জল্পনা চালাচ্ছে!
কিন্তু প্রকাশ্যে মুকুল যা-ই দাবি করুন, জল্পনার তো বিরাম নেই। দলের মধ্যেই চর্চা হচ্ছে, সারদা-তদন্তের এই অবস্থায় মুকুলের পক্ষে বিজেপিতে যাওয়া সম্ভব নয়। মুকুলের মতো কাউকে তাঁরা ‘১০০ কিলোমিটার দূর থেকেও’ ছুঁয়ে দেখবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন সিদ্ধার্থনাথ সিংহের মতো বিজেপি নেতা। তা হলে কি দলের মধ্যেই প্রায় আলাদা দলের মতো থেকে যাবেন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক? জোর কানাঘুষো এখন তৃণমূলেই। দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাড়তি দায়িত্ব দিয়ে এমনিতেই মুকুলকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন মমতা। সদস্যপদ পর্যালোচনা কমিটিতে এক কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুকুল এখন এক সাধারণ সদস্য মাত্র! কলকাতা পুরভোটের কমিটিতে তাঁকে রাখা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আগে যেখানে পুরভোটের প্রস্তুতিতে একচ্ছত্র দাপট ছিল মুকুলের, এ বার সেখানে রাজ্যের অন্যত্র পুরভোটের কমিটি গড়ার কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা সভাপতিদের। তৃণমূলের এক বর্ষীয়ান নেতার মন্তব্য, “সংগঠনের খুব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কিছুই প্রায় এখন মুকুলের হাতে রাখেননি দলনেত্রী। বনগাঁ উপনির্বাচনে যে দায়িত্বের কথা মুকুল নিজের মুখে বলেছে, সেখানেও আনুষ্ঠানিক ভার কিন্তু উপেন বিশ্বাসের! তা হলে ওর কাছে আর রইল কী?”
অবস্থা বেগতিক বুঝে মুকুলও এখন নানা তাস খেলছেন। ফুরফুরা শরিফে গিয়ে মুকুল দেখা করার পরেই তাঁর সুরে পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি বিবৃতি দিয়েছেন, “সিবিআই তো তদন্ত করবেই। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তারা কাজ করছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ না মানলে আমার তো ভারতের নাগরিক থাকারই অধিকার নেই!” মুকুল জানেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে প্রভাবের কারণে ত্বহাকে সমঝে চলেন মমতা। তাই তাঁকে দিয়ে নিজের কথা বলিয়ে নিলেন বলে মনে করছে দলের একাংশ! তবে তৃণমূলের অন্য সূত্রের পাল্টা দাবি, ক’দিন আগেই ধর্মান্তরণ নিয়ে মমতার সুরে বিজেপিকে তোপ দেগেছিলেন ত্বহা। মঞ্চে তখন বসে শিক্ষামন্ত্রী এবং তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়! কাজেই ত্বহা কখন কী বললেন, তা দিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়।
মুকুল যখন দূরে দূরে থাকছেন, তাঁকে নিয়ে আতঙ্ক থেকে রেহাই পাচ্ছেন না নেত্রীও। আগের দিনই তিনি দলীয় বৈঠকে জানিয়েছিলেন, সিবিআইয়ের কাছে মুকুল নাকি অভিষেকের নাম করেছেন বলে ‘লোকে বলছে’! দলের কারও কারও বক্তব্য, ভাইপোর নাম যদি মুকুল সিবিআইয়ের কাছে বলে থাকেন, পিসির নামও যে বলেননি তার নিশ্চয়তা কী? মমতা-ঘনিষ্ঠেরা তাই মুকুলকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করছেন! খবর নিচ্ছেন ঘন ঘন।
শনিবার সন্ধেয় নিজাম প্যালেস থেকে বেরিয়েছিলেন মুকুল। রাত ৯টা নাগাদ ফিরে দেখেন, তখনও সংবাদমাধ্যমের কয়েক জন অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে! বিস্মিত মুকুলের প্রশ্ন, তাঁকে পাহারা দেওয়া হচ্ছে নাকি? এই ভিড়ের জন্যই অনেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও আসতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী। যা থেকেও আবার নতুন জল্পনা তা হলে কি গোপনে তেমন কারও সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল?
বিরোধীরা এই অবস্থার পূর্ণ ফায়দা নিতে তৎপর। সারদা নিয়ে মুকুলের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগকারী, সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব এ দিন ফের মুখ খুলেছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সমাবেশে তিনি বলেন, “মুকুলের মুখে এখন চওড়া হাসি! গোপনে কোনও সমঝোতা হয়ে গেল? কিন্তু মুকুলকে ছাড় দিলে সিবিআইকেই জেলে যেতে হবে! সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত হচ্ছে।” গৌতমবাবুর আরও বক্তব্য, “আমি তো অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন তুলছি, ভাই-ভাইপো সব হঠাৎ ফুলেফেঁপে উঠলেন কী ভাবে? তদন্ত হোক না! তদন্ত হলেই সব পরিষ্কার হবে।”
মেদিনীপুরে সিপিআইয়ের প্রাক্তন সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত এ দিনই বলেছেন, “মাত্র সাড়ে তিন বছরে রাজ্য সরকারের এমন বেহাল দশা? মন্ত্রী জেলে, নবান্নে নন। সাংসদেরা সংসদে নন, জেলে। ভাবা যায়?” রিষড়ায় মিছিল করে কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, “তৃণমূল নেত্রীর এখন মুকুল-আতঙ্ক হয়েছে! উনি বুঝেছেন, লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষকে সর্বস্বান্ত করার জন্য জেলে ওঁকে যেতেই হবে।” একই কটাক্ষ করেছেন মান্নানের দলের প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীও। শনিবারই দলের বৈঠকে মমতা বলেন, তিনি জেলে যেতে ভয় পান না। সেই প্রসঙ্গ তুলে অধীরের কটাক্ষ, “ঠাকুরঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি! উনি নিজেই বলে দিলেন জেলে যাবেন! জেলে গিয়ে কী করবেন, তা-ও ঠিক করে ফেলেছেন!” বিজেপি-বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, “বিহার, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, অসম রাজ্য যেখানে সারদায় সিবিআই তদন্ত মেনে নিয়েছিল, সেখানে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গই তার বিরোধিতা করেছিল। আসলে সারদায় গরিব মানুষের টাকা তৃণমূল নেতারা লুঠ করেছেন বলেই সিবিআই তদন্ত চাননি।”