কাঁটাতার পেরিয়ে। কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে ভোট দিতে আসছেন ও-পাশে থাকা ভারতীয় গ্রাম হুদোদিগম্বরপুরের বাসিন্দা। শুক্রবার। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
উত্তর ২৪ পরগনায় ভোট থাকলে তাঁর ডেরা হয় মধ্যমগ্রামে দলের জেলা দফতরেই। ডেরা এ বারও বদলায়নি। কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে যুদ্ধের মেজাজটাই!
মধ্যমগ্রামে দলীয় দফতরে বসেই অতীতে জেলার একাধিক ভোট পরিচালনা করেছেন মুকুল রায়। কিন্তু শুক্রবার সেই একই ঠিকানায় সেই পরিচিত ‘ওয়ার রুমে’র পরিবেশ ধরা পড়ল না! বরং, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে দেখা গেল কখনও দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে, কখনও বা পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলতে। বনগাঁ বা কৃষ্ণগঞ্জের উপনির্বাচন নিয়ে তাঁর কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াও নেই। জানতে চাইলে মুকুল শুধু বলেছেন, “সাংবাদিক সম্মেলন বনগাঁয় জেলা সভাপতি করবেন। তৃণমূল ভবনেও হবে। আমি কিছু বলব না।”
তৃণমূলের বিধায়ক নির্মল ঘোষ, শীলভদ্র দত্ত, দলের যুবনেত্রী ঋতুপর্ণা সাহা, ছাত্র নেতা সুজিত শ্যাম প্রমুখ ছিলেন মুকুলের সঙ্গে। বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ নির্মলবাবু বেরোলেন বনগাঁর দিকে। প্রায় একই সময়ে দফতরে ঢুকলেন রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক শঙ্কুদেব পণ্ডা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মুকুল ঠায় বসে মধ্যমগ্রামের দফতরেই। মাঝে মাঝে মোবাইল বাজছে। চাপা স্বরে কথা বলেছেন। মুখ বেশ গম্ভীর। অন্যান্য বার ভোটের শতাংশ নিয়ে যে হিসেবনিকেশে ডুবে থাকতেন, এ বার তেমন কিছুও করতে দেখা গেল না! ভোটের প্রচারে যেমন নিস্পৃহ ছিলেন, এ দিনও সেই রকম রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন যেন!
এই ফোনের পরেই মেজাজ বদল মমতার (বাঁ দিকে)। মধ্যমগ্রামে দলের দফতরে মুকুল। নিজস্ব চিত্র।
কথাবার্তার ফাঁকে বেলা আড়াইটে নাগাদ মুকুল বলেন, “বুথে বুথে বড় লাইন পড়েছে শুনছি। বনগাঁয় ভোটের হার ৭৫% ছাড়িয়ে যাবে। কৃষ্ণগঞ্জে ৮০% তো হবেই।” দিনের শেষে তাঁর অনুমান মিলে গিয়েছে! কথার মাঝেই দলীয় এক কর্মী অনুরোধ করলেন দুপুরের খাবারের জন্য। মুকুল খেলেন না। সেই কর্মী বললেন, “এক টুকরো মাছ অন্তত খান!” এ বার হেসে মুকুলের জবাব, “রেঁধেছিস তো পমফ্রেট মাছ! আমি খাই না।” অনুরোধকারীর বিস্মিত মন্তব্য, “কী মাছ রান্না হয়েছে, দাদা এটাও জানেন!” মুকুলের খাদ্য বলতে তখন ঘন ঘন চা, কফি আর সিগারেট।
মুকুল যেমন সারা দিন দলীয় দফতরে বসে রইলেন, তাঁর বিধায়ক-পুত্র শুভ্রাংশুও ভোট চলাকালীন নিজেকে বন্দি রেখেছিলেন কাঁচরাপাড়ার বাড়িতে। সন্ধ্যায় এসেছিলেন কলকাতায়। মুকুল ও তাঁর অনুগামীরা উপনির্বাচনে ঠিক কী ভূমিকা নেবেন, তা নিয়ে নানা জল্পনা ছিলই। সপুত্র মুকুলের গা-ছাড়া মনোভাব এ দিন সেই জল্পনা আরও জোরদার করেছে। গুঞ্জন উঠেছে, শুভ্রাংশু তাঁর অনুগামীদের দিয়ে কি বিজেপি-র হয়ে ভোট করালেন?
সে জল্পনার গতি এতই তীব্র, তার কবল থেকে মুক্ত ছিলেন না স্বয়ং তৃণমূল নেত্রীও! মিলন মেলায় সরকারি অনুষ্ঠান চলাকালীন হঠাৎ এসে-পড়া একটি ফোন এ দিন রীতিমতো মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের! তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ সুব্রত বক্সীর কাছেই এসেছিল ফোন। সামান্য কথা বলে তিনি মোবাইল এগিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রীর দিকে। ফোনের ও’পারের কথা শুনেই মুখ্যমন্ত্রী চলে যান একেবারে মঞ্চের পিছন দিকে। বন্ধ হয়ে যায় অসংগঠিত শ্রমিকদের চেক বিতরণ। মিনিট তিনেক কথা বলে ফিরে এসে বক্সীর হাতে ফোন ফেরত দিয়ে বিরক্ত মুখে বসে থাকতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। তার পরেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে উঠে প্রথমে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং একটু পরে বক্সীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তত ক্ষণে ফের শুরু হয়েছে চেক বিতরণ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর মন তখন আর চেক প্রদানে নেই! দৃশ্যতই উত্তেজিত মমতাকে কথা বলতে দেখা যায় দুুই সুব্রতবাবুর সঙ্গে। চেক প্রাপকদের দিকে তখন তাঁর ভ্রূক্ষেপই নেই! কথা বলতে বলতেই তিনি তাঁদের হাতে চেক তুলে দিতে থাকেন। তার পরে শুরু হয় সাইকেল দান পর্ব। কিন্তু মাঝপথেই মঞ্চ ত্যাগ করেন মুখমন্ত্রী।
দলের মধ্যে জল্পনা, তৃণমূল নেত্রীর কাছে নাকি ফোন এসেছিল মুকুল-পুত্র বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে নদিয়া জেলার অংশে শাসক দলের হয়ে ভোট করাচ্ছেন না! তাতেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন দলনেত্রী। যদিও ফোনের রহস্য শেষ পর্যন্ত ভেদ করা যায়নি। কল্যাণী, গয়েশপুরে বিরোধীরা তৃণমূলের গা-জোয়ারির দিকেই আঙুল তুলেছে দিনভর, এই তথ্য উল্লেখ করে শাসক দলের একাংশ আবার পাল্টা বলছে, তা হলে আর শুভ্রাংশুদের নিয়ে জল্পনা কেন? শুভ্রাংশুর বক্তব্য, ‘‘আমি তো সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। বাড়িতে বসেই যদি ভোট করাই, তা হলে তো আমি বিরাট প্রভাবশালী হয়ে গিয়েছি মনে হচ্ছে!” আর বক্সী পরে জানিয়েছেন, সরকারি অনুষ্ঠানের মাঝে ফোন এসেছিল গয়েশপুরের দলীয় এক কর্মীর কাছ থেকে। সচিত্র পরিচয়পত্র ছিল না বলে তিনি ভোট দিতে পারছিলেন না। এই খবর শুনেই নাকি খুব বিরক্ত হয়েছিলেন মমতা।
যদিও দলের একাংশ বলছে, কোথায় কোন এক কর্মী ভোট দিতে পারলেন না, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিচলিত হয়ে পড়বেন কেন? তাঁর আসল উদ্বেগের কারণ মুকুলদের দল ছাড়া নিয়ে জল্পনাই! যে জল্পনা উড়িয়ে মুকুলের মন্তব্য, “সবই ভিত্তিহীন, অসত্য কল্পনা!” বিভাজনের স্পষ্ট চিহ্ন আড়াল করতে চেয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও দাবি, “নেত্রী এক জনই। আমরা সবাই তাঁর সৈনিক!”
সৈনিকেরা সব জোড়া ফুলের জন্যই প্রাণপাত করলেন কি না, তা অবশ্য বোঝা যাবে সোমবার! ভোট-গণনার পরে!