বানভাসি উত্তর। জলমগ্ন আলিপুরদুয়ারের দেবীনগর এলাকা। ছবি: রাজু সাহা।
এক দিকে বন্যার আশঙ্কা। অন্য দিকে আকাশের চোখরাঙানি, ফুটিফাটা মাঠ।
এক দিকের মানুষ বলছেন, আর নয়। এ বার একটু থামুক। অন্য দিকের মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে। কখন নামবে তার প্রত্যাশায়।
তবে একটি ব্যাপারে দু’তরফেরই দারুণ মিল। দু’দিকের কৃষকই তাঁর ফসল বাঁচাতে ব্যস্ত। দক্ষিণে বৃষ্টি না হওয়ায়। উত্তরে ভয়টা অতিবৃষ্টির। আবহাওয়া উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিণবঙ্গকে পুরোপুরি যেন দু’টি আলাদা ভৌগোলিক ক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
মায়ানমার, মিজোরাম, অসম হয়ে উত্তরবঙ্গে ঢুকে বর্ষা যখন তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে, তখন দক্ষিণবঙ্গে কবে তা আসবে, সে ব্যাপারে কোনও পূর্বাভাসই দিতে পারছে না হাওয়া অফিস। বরং প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের বায়ুপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে আবহবিদেরা যা বলছেন, সেটা দক্ষিণবঙ্গের মানুষের কাছে মোটেই অভিপ্রেত নয়।
এ বছর সারা দেশেই স্বাভাবিকের থেকে কম বৃষ্টি হবে বলে দিল্লির মৌসম ভবন পূর্বাভাস দিয়েছিল গত মাসে। এই ঘাটতি বর্ষার জন্য তারা দুষছে এল নিনোকে। আবহবিদেরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার কমা-বাড়ার উপরে নির্ভর করে এল নিনোর ভবিষ্যৎ। জলের তাপমাত্রা বাড়লে এন নিনোর শক্তি বাড়ে। কমলে এল নিনো দুর্বল হয়ে যায়। তার কোনও কুপ্রভাবই পড়ে না আবহাওয়ায়। বর্ষা নিয়ে দ্বিতীয় দফার পূর্বাভাস দেওয়ার সময়ে মৌসম ভবন জানিয়ে দিয়েছিল, এ বার বর্ষা ঠিক কতটা হবে, তা নির্ভর করছে এল নিনো কতটা শক্তিশালী হবে তার উপরে।
বুধবারই জাপানের আবহাওয়া দফতর (ওয়েদার ব্যুরো) জানিয়ে দিয়েছে, এল নিনো পরিস্থিতি কিন্তু ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে। আগামী শীত পর্যন্ত তার শক্তি বাড়তেই থাকবে। ভারতে বর্ষার জন্য সেটা যে খুবই খারাপ খবর, তা জানাতে ভোলেননি মৌসম ভবনের আবহবিদেরা। জাপানের আবহাওয়া দফতরের বিশ্লেষণের সঙ্গে তাঁরা মিলিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া দফতর (ব্যুরো অব মেটেরোলজি)-র পূর্বাভাসও।
কী বলেছে অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাভাস?
তারা বলেছে, প্রশান্ত মহাসাগরের জলস্তরের তাপমাত্রা এখন বাড়ছেই। গোটা ২০১৫ সাল ধরে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলবে। যার অর্থ, এল নিনো তার শক্তি বৃদ্ধি করে যাবে বছরের বাকি সময়টা ধরে। জাপানের আবহাওয়া দফতরের সঙ্গে বস্তুত পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস। যা ভারতের বর্ষা-ভাগ্য নিয়ে সংশয় বা়ড়াচ্ছে। আবহবিদেরা বলছেন, এল নিনোর সঙ্গে ভারতে বর্ষার সম্পর্কটা ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ এল নিনো শক্তিশালী হলে বর্ষা দুর্বল হবে। এর ব্যতিক্রমও অবশ্য রয়েছে। মৌসম ভবনের রেকর্ড বলছে, ১৯৯৭ সালে শক্তিশালী এল নিনোর বছরে ভারতে বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ঘটনাটিকে অবশ্য ব্যতিক্রমী বলেই মনে করছেন আবহবিদেরা। কারণ, এ বার ইতিমধ্যেই বর্ষায় এল নিনোর প্রতিকূল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
এল নিনো যদি বর্ষাকে দুর্বলই করে দেবে তা হলে অসম, মেঘালয়, উত্তরবঙ্গে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে কী ভাবে? উত্তরবঙ্গে বন্যার সতর্কতাই বা কী ভাবে জারি করছে হাওয়া অফিস?
আবহবিদেরা বলছেন, ভারতে বর্ষা ঢোকার দু’টি পথ রয়েছে। একটি আন্দামান পথ। যা মায়ানমার হয়ে ঢোকে উত্তরবঙ্গে। ওই পথে বর্ষা এ বার আগেই ঢুকে পড়েছে আন্দামানে। এল নিনো শক্তি সঞ্চয় করার আগেই ওই পথে বর্ষা সক্রিয় হয়ে মায়ানমার হয়ে ঢুকে পড়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। তার ফলে এল নিনো আর ছুঁতে পারেনি বর্ষার ওই পথটিকে। তবে বর্ষার যে পথটি কেরল হয়ে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢোকে, সেটি পথে দেরি করে ফেলায় তা এল নিনোর খপ্পরে পড়ে গিয়েছে। এখন তা খোঁড়াচ্ছে। আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড় ভারতের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প ঢোকানোয় গুজরাত, মুম্বইয়ে ভাল বৃষ্টি হচ্ছে। ভুগছে মধ্য ও পূর্ব ভারত।
নিয়মমতো তার কলকাতায় এসে পৌঁছনোর কথা ছিল ৮ জুন। কিন্তু কলকাতা-সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা কবে ঢুকছে, সে ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে হাওয়া অফিস সাফ জানিয়েছে, ‘‘এখনও কিছু বলার সময় আসেনি। শুক্রবার নাগাদ কোনও পূর্বাভাস দেওয়া যেতে পারে।’’
মঙ্গলবার বীরভূমে বজ্রপাতে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্ধমানেও বৃষ্টি হয়েছে। কলকাতায় বিদ্যুৎ চমকেছে, কোথাও কোথাও বৃষ্টি পড়েছে কয়েক ফোঁটা। বর্ষার যদি কোনও খবরই না থাকে তো এগুলি কীসের লক্ষণ?
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেছেন, বর্ষার সঙ্গে ওই বৃষ্টির কোনও সম্পর্কই নেই। ওটা কালবৈশাখী। তবে জোরদার না হওয়ায় তা বর্ধমান পৌঁছনোর আগেই ভেঙে যাচ্ছে। তাই কলকাতা ও আশপাশের এলাকায় জোরদার বর্ষণ হচ্ছে না। আগামী কয়েক দিনও ঝাড়খণ্ডে কালবৈশাখী তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন গোকুলবাবু। তার থেকে দু’একটা কলকাতার উপরে ভেঙে পড়তেও পারে। বর্ষা না আসুক, চরম অস্বস্তি কাটাতে ওই বৃষ্টির অপেক্ষাতেই রয়েছে চাতক শহর।