ফাইল ছবি
যার প্রবল দাপটে রাজ্য সরকার দ্বিতীয় দফায় স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি দীর্ঘায়িত করেছে, সেই গরমই তেজ সংবরণ করেছে অনেকাংশে। সেই গ্রীষ্মতেজ প্রশমনের ধারা অব্যাহত থাকারই ইঙ্গিত দিচ্ছে উত্তরবঙ্গে সেজেগুজে সমাগত মৌসুমি বায়ু। আবহাওয়া দফতর বলছে, জ্যৈষ্ঠ শেষে আষাঢ়ের পায়ে পায়ে দক্ষিণবঙ্গেরও দরজায় কার্যত কড়া নাড়ছে বর্ষা। এই পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ রেখে গরমের ছুটি বাড়ানোর কী দরকার, সেই প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে অবিলম্বে স্কুলে পঠনপাঠন শুরু করে দেওয়ার আর্জিও জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বড় অংশের বক্তব্য, বর্ষা যখন সমাগত, বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করে স্কুল খুলে দেওয়া হোক। উত্তর কলকাতার সরস্বতী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জয়তী মজুমদার মিত্র বলেন, ‘‘এখন যদি ছুটি কমিয়ে দু’দিনের মধ্যে স্কুল খুলতে বলে, তা হলেও আমরা তৈরি। স্কুল তো ১৬ জুন থেকে খোলার কথাই ছিল। আমরা প্রস্তুত ছিলাম, আছিও।’’
প্রথম দফায় গরমের ছুটি এগিয়ে এনে তার দৈর্ঘ্য বাড়ানোর পরেই তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল। এ বারেও প্রায় একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি। অনেকেরই প্রশ্ন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস মাথায় রেখে কি ছুটি দেওয়া হচ্ছে? নাকি খামখেয়ালি পদ্ধতিতেই ছুটি দিচ্ছে সরকার? বর্ষা যদি দুর্বল হয়, তা হলে ২৭ জুনের পরেও যে আবহাওয়া অস্বস্তিকর হবে না, তা কি সরকার নিশ্চিত ভাবে বলতে পারে?
শিক্ষক শিবিরের যুক্তি, সরকার যদি এক দিনের নোটিসে ছুটি বাড়িয়ে দিতে পারে, তা হলে সেটা কমাতেও পারে এক দিনের নোটিসে। এই আবহাওয়া দেখে অবিলম্বে স্কুল খোলার নির্দেশ দেওয়া হোক। আজ, বৃহস্পতিবার থেকেই তো বেশির ভাগ স্কুল খোলার কথা ছিল। পড়ুয়া থেকে শিক্ষক, সকলেই প্রস্তুত। বৃহস্পতি বা শুক্রবার নোটিস দিয়ে সোমবার থেকে স্কুল খুলে দিলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। পড়ুয়ারা খুশি হয়েই স্কুলে যাবে। স্বস্তি পাবেন অভিভাবকেরা। সর্বোপরি করোনাকালে শিক্ষার ক্ষত ও ক্ষতির মোকাবিলায় কোমর বেঁধে নামতে পারবে পড়ুয়া ও শিক্ষক শিবির।
মঙ্গলবার রাতে দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। বুধবার সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘলা। আর্দ্রতার অস্বস্তি থাকলেও দহনের জ্বালা কমেছে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, বুধবার রাত থেকেই প্রাক্বর্ষা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বঙ্গে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গাঙ্গেয় বঙ্গে বর্ষা ঢোকার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে গাঙ্গেয় বঙ্গে বর্ষা আপাতত দুর্বল থাকবে। কারণ, উত্তরবঙ্গে জোরালো বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বর্ষার আগমনের ফলে তাপমাত্রা কমে যেতে পারে।
গত কয়েক দিনে তাপমাত্রা মারাত্মক বাড়েনি। আর্দ্রতার অস্বস্তি যে অসহনীয়, এমনও নয়। প্রতি বছরেই এই সময়ে কমবেশি এমন অস্বস্তি থাকে। তবু ‘প্রচণ্ড গরমের জন্য’ ২৬ জুন পর্যন্ত গ্রীষ্মাবকাশ বাড়িয়েছে সরকার। বেসরকারি স্কুলকেও গরমের ছুটি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সরকারের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে প্রায় সব আইসিএসই এবং সিবিএসই স্কুলই ছুটি বাড়িয়ে অনলাইনে পঠনপাঠন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রথম দফায় ৪৫ দিন এবং তার পরে আরও ১১ দিন গরমের ছুটি দেওয়ায় স্কুল বন্ধ প্রায় দু’মাস। এত দীর্ঘ ছুটির ফলে পড়ুয়াদের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। জানকী মণ্ডল নামে পাটুলির এক ছাত্রীর অভিভাবক বলেন, ‘‘ফের গরমের ছুটি বেড়ে যাওয়ায় মেয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। স্কুল শুরু হল ফেব্রুয়ারিতে। তিন মাস যেতে না-যেতেই স্কুলে সেই যে গরমের ছুটি পড়ল, আর খোলার নাম নেই।’’ পূর্ণেন্দু ঘাটা নামে অন্য এক অভিভাবক বলেন, ‘‘মনের দিক থেকে পড়ুয়ারা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বারণ করলে তিরিক্ষি মেজাজ দেখাচ্ছে।’’
অভিভাবকদের প্রশ্ন, প্রতি বারেই তো ছেলেমেয়েরা গরমের মধ্যে স্কুল করে। এ বার কী এমন হল যে, গরমের জন্য এত লম্বা ছুটি দিতে হচ্ছে? এটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না ছাত্রছাত্রীদের। যদিও দ্বিতীয় দফায় গরমের ছুটি বাড়ানোর আগে রাজ্য সরকার বলেছিল, পানিহাটির মেলায় গরমে তিন পুণ্যার্থীর মৃত্যুর পরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্কুলে ছুটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মতিলাল গিরি নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘কেন্দ্রের শিক্ষানীতিতে অনলাইন ক্লাসের উপরে জোর দিতে বলা হয়েছিল। রাজ্য সরকার সেই কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করছে বাইরে থেকে। কিন্তু গভীরে চিন্তা করলে দেখা যাবে, রাজ্য তো কেন্দ্রের শিক্ষানীতিই সমর্থন করে সেগুলোকে প্রয়োগ করছে। রাজ্যও তো স্কুল বন্ধ রেখে অনলাইন ক্লাসের জন্য উৎসাহিত করছে।’’ রাজ্য সরকার আদৌ শিক্ষার উন্নতিতে উৎসাহী কি না, সেই সন্দিগ্ধ প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।