মমতা মানলেই ঘরে ঘরে উজালা পুজোর পরে

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবুজ সঙ্কেত পেলেই পুজোর পরেই রাজ্যে আসতে চলেছে সস্তার মোদী-আলো। তাতে বাজার দরের থেকে অনেক সস্তায় এলইডি বাল্‌ব কিনতে পারবেন রাজ্যের মানুষ। কেন্দ্রের বক্তব্য, রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা অনেকটাই ইতিবাচক জায়গায় রয়েছে।

Advertisement

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩১
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবুজ সঙ্কেত পেলেই পুজোর পরেই রাজ্যে আসতে চলেছে সস্তার মোদী-আলো। তাতে বাজার দরের থেকে অনেক সস্তায় এলইডি বাল্‌ব কিনতে পারবেন রাজ্যের মানুষ। কেন্দ্রের বক্তব্য, রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা অনেকটাই ইতিবাচক জায়গায় রয়েছে। এই বাল্‌ব নিয়ে রাজ্যেরও আগ্রহ রয়েছে। ফলে রাজ্যের ছাড়পত্র পেলে এ বছর উৎসবের মরসুমেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের ‘উজালা’ প্রকল্পের সূচনা হয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গে। সরকারি ভবনে কিয়স্ক বসিয়ে এলইডি বাল্‌ব বিক্রি শুরু করবে কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘এনার্জি এফিসিয়েন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড’ (ইইএসএল)।

Advertisement

এতে লাভ কী হবে?

• প্রথম লাভ সাধারণ মানুষের। সস্তায় এলইডি বাল্‌ব পাবেন তাঁরা। এই বাল্‌ব টেকসই। বিদ্যুতের বিলও কমে আসবে।

Advertisement

• বাঁচবে দেশের বিদ্যুৎ।

• উষ্ণায়নেও রাশ টানা যাবে।

কেন্দ্রের হিসেবে, এলইডি বাল্‌ব ব্যবহারে সাধারণ গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল বছরে ১৬০-৪০০ টাকা কম হতে পারে। বাজারে এলইডি বাল্‌বের দাম ১৫০-৪৫০ টাকা। উজালা প্রকল্পে সেটিই মিলবে ৭৫-১০০ টাকায়। ভবিষ্যতে এই দাম আরও কমবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের গ্রাহকদের জন্য টিউবলাইট দেওয়ারও আর্জি জানিয়েছে। এর বাজার দর এখন ৬০০ টাকার মতো। উজালা প্রকল্পে মিলবে ২৩০ টাকার মধ্যে।

বিদ্যুৎ মন্ত্রকের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইইএসএল-এর কর্তারা জানাচ্ছেন, একটি ৬০ ওয়াটের সাধারণ বাল্‌বের থেকে ৭ ওয়াটের এলইডি বাল্‌ব অনেক বেশি উজ্জ্বল। সিএফএল বা অন্য বাল্‌বের থেকেও ৫০-৮০ শতাংশ বেশি টেকসই। তিন বছরের মধ্যে খারাপ হলে উজালা প্রকল্পে দেওয়া বাল্‌ব বিনামূল্যে বদলেও দেওয়া হবে।

আম জনতারই যে শুধু উপকার হবে তা নয়, উজালা প্রকল্প উষ্ণায়ন রোধে ও বিদ্যুৎ বাবদ খরচ কমাতেও বিশেষ কাজে আসবে। উষ্ণায়নের জন্য দায়ী ‘গ্রিন হাউস গ্যাস’ তথা মূলত কার্বন-গ্যাসের নিঃসরণ। প্রধানমন্ত্রী মোদীর লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ ৩৩ থেকে ৩৫ শতাংশ কমানো। এর জন্য দেশের ৭৭ কোটি সাধারণ বাল্‌ব এলইডি-তে বদলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রের মতে, এতে প্রতি বছর ৮ কোটি টন ‘গ্রিন হাউস গ্যাস’-এর নিঃসরণ কমবে। আর ২০১৯-এর মার্চের মধ্যে বিদ্যুতের সাশ্রয় হবে ২০ হাজার মেগাওয়াট ।

এই সব কারণেই সব রাজ্যকে উজালা প্রকল্পে সামিল হতে বলা হচ্ছে। ইইএসএল-এর এমডি সৌরভ কুমারের কথায়, ‘‘সরকারের লক্ষ্য, ২০১৯-এর মার্চের আগেই গোটা দেশে এলইডি বাল্‌ব ছড়িয়ে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী র নির্দেশে উজালা প্রকল্পের কাজ তাই দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযূষ গয়াল মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন।’’ ইতিমধ্যেই বেশ কিছু রাজ্য উজালা প্রকল্পে সামিল হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডুর মতো কয়েকটি রাজ্য এত দিন সাড়া দেয়নি। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পরে শেষ পর্যন্ত রাজ্যগুলি থেকে সাড়া মিলতে শুরু করেছে।

কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী গয়াল ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক বার মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে দেখা করে পশ্চিমবঙ্গে উজালা প্রকল্প চালু করার ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছেন। সূত্রের খবর, রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতর কেন্দ্রের প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য অর্থ দফতরে পাঠিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সবুজ সঙ্কেত দিলেই অর্থ দফতর উজালা প্রকল্পে সিলমোহর দিয়ে দেবে। এই অনুমোদন যাতে দ্রুত পাওয়া যায়, তার জন্য ইইএসএল-এর কর্তারা নিয়মিত বিদ্যুৎ দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

কেন আপত্তি ছিল রাজ্যের?

কেন্দ্রের প্রস্তাব ছিল, রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কাছ থেকে এলইডি বাল্‌ব কিনে গ্রাহকদের দিক। আর এলইডি বাল্‌ব ঘরে লাগানোর ফলে প্রতি মাসের বিলে যে টাকা বাঁচবে, সেই অর্থ বাল্‌বের দাম বাবদ কিস্তিতে আদায় করুক। কিন্তু এলইডি বাল্‌ব বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনও রকম আর্থিক দায় নিতে রাজি নয় রাজ্য সরকার। যে কারণে মমতা সরকার এত দিন উজালা প্রকল্প নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। রাজ্যের বিদ্যুৎ কর্তাদের বক্তব্য ছিল, এমনিতেই বিল আদায় করতে গিয়ে তাঁদের কালঘাম ছুটে যায়। তার সঙ্গে এলইডি বাল্‌ব বণ্টন করা, তার টাকা আদায় করা বাড়তি ঝামেলা। এতে রাজ্যের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপারও আশঙ্কা থেকে যাবে।

রাজ্যের আপত্তির জেরেই পথ পাল্টেছে কেন্দ্র। এখন তারা প্রস্তাব দিয়েছে, রাজ্যকে কোনও আর্থিক দায় নিতে হবে না। শুধু ‘কিয়স্ক’ খোলার ব্যবস্থা করলে ইইএসএল নিজেই রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার গ্রাহকদের এলইডি বাল্‌ব বিক্রি করবে। তাতে রাজ্যের ঘাড়ে আর্থিক লেনদেনের দায় তো থাকবেই না, উল্টে ভ্যাট বাবদ তিন বছরে ৭৫ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের। কারণ ইইএসএল মনে করছে, এ রাজ্যে কমপক্ষে ১০ কোটি এলইডি বাল্‌ব বিক্রি করা সম্ভব। তার সঙ্গে টিউবলাইট, ফ্যান বিক্রি হলে রাজ্যের কোষাগারে জমা পড়তে পারে ১৮৫ কোটি টাকা। অক্টোবর থেকে এই প্রকল্প শুরু হয়ে গেলে শুধুমাত্র উৎসবের মরসুমে মোটা অঙ্ক যোগ হতে পারে সরকারের ভাঁড়ারে।

এই প্রস্তাবেই খানিকটা হলেও রাজ্যের মন গলেছে বলে কেন্দ্রীয় কর্তারা দাবি করছেন। রাজ্যের বিদ্যুৎ দফতর সূত্রে খবর, নবান্নের অনুমতি পেলেই রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রগুলিতে কিয়স্ক খোলার জন্য ইইএসএল-কে জায়গা দেওয়া হবে। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার গ্রাহকরা সেখান থেকেই এলইডি বাল্‌ব কিনতে পারবেন। সিইএসসি এবং ডিপিএল এলাকাতেও এক পদ্ধতিতে এই বাল্‌ব বিক্রি হবে। এর বেশি কোনও দায় রাজ্য নিচ্ছে না। রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেন্দ্রের প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য অর্থ দফতরের কাছে পাঠানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’

কেন্দ্রের আরও প্রস্তাব, রাস্তাঘাট, নদীর ঘাটের মতো যে সব জায়গা জনসাধারণ ব্যবহার করেন সেখানেও অন্য আলোর বদলে এলইডি লাগানো হোক। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভ হোক বা বারাণসীর ঘাট— অনেক জায়গাতেই এলইডি লাগানো হয়েছে।’’ রাজ্য সরকার অবশ্য এখনই দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন পুরসভা এলাকায় এই আলো বিলি করার প্রস্তাবে সায় দিচ্ছে না।

তবে রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, তাঁরাও চান এলইডি-র ব্যবহার বাড়ুক। পরিবেশ-বান্ধব এই বাল্‌ব যে কম বিদ্যুৎ খরচে বেশি আলো দেয়, সেটা এখন আর অজানা কিছু নয়। সমস্যা এর দাম নিয়ে। উজালায় তা সস্তায় পেলে অনেকেই এলইডি-তেই আলো করতে চাইবেন ঘর। এখন শুধু মুখ্যমন্ত্রীর সায় মেলার অপেক্ষা।

এলইডিতে রোজ লাভ

• ১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে এলইডি বাল্‌ব বণ্টন হয়েছে ১৬.৬৩ কোটি

• বিদ্যুৎ সাশ্রয় প্রতিদিন ৫.৯২ কোটি কিলোওয়াট আওয়ার

• আর্থিক সাশ্রয় প্রতি দিন ২৩.৬৩ টাকা

• কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কম হচ্ছে প্রতি দিন ৪৭৯১৮ টন

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement