মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। —ফাইল চিত্র।
সারদার কাছ থেকে পাওয়া টাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন মিঠুন চক্রবর্তী। পর্দায় চিরকাল ‘গরিবোঁ কা দাতা’ বলে পরিচিত তিনি। যাবতীয় ‘অন্যায় অবিচার’ এবং ‘পাপ কি কামাই’-এর দুশমন। সেই তাঁর পক্ষে ‘গরিবের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা টাকা’ হজম করা সম্ভব নয় বলেই ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন নায়ক।
এক সময় সারদার মালিকানাধীন টিভি চ্যানেলে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন মিঠুন। সেই বাবদ সারদার কাছ থেকে তিনি পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। এখন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সেই টাকাই তিনি ফেরত দিতে চান। চলতি সপ্তাহেই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে পৌঁছে যাওয়ার কথা ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকার একটি ব্যাঙ্ক ড্রাফট।
কলকাতায় মিঠুনের আইনজীবী বিমান সরকার সোমবার জানান, সারদার সঙ্গে মোট ৪২টি এপিসোড-এর জন্য দু’কোটি টাকার চুক্তি হয়েছিল মিঠুনের। সবগুলিরই শ্যুটিং হয়ে যায়। তার মধ্যে ২৩টি এপিসোড সম্প্রচারও হয়েছিল। বিমানবাবু বলেন, ‘‘সারদার তরফে তাঁকে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিল।’’ ওই টাকা পাওয়ার পরে প্রায় ৫৩ লক্ষ টাকা আয়কর বাবদ দিয়েছিলেন মিঠুন। সেই অংশটা কেটে নিয়ে তিনি বাকিটা ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিমানবাবু।
যে ‘মানি লন্ডারিং’ আইনকে সামনে রেখে ইডি তদন্ত করছে, সেখানে কিন্তু বলা আছে— কোনও পরিষেবার বিনিময়ে যদি টাকা নেওয়া হয়ে থাকে, তা হলে সেই টাকা ফেরত দিতে হবে না। এই হিসেবে ২৩টি এপিসোডের টাকা মিঠুন ফেরত না-ও দিতে পারতেন। তবে দেওয়া পরিষেবা এবং নেওয়া টাকার পরিমাণ বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা ইডি-র। ই়ডি সূত্রের খবর, সারদার কাছ থেকে মিঠুন যে টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়েছিলেন, তা বাজারদরের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সাংবাদিক-সাংসদ কুণাল ঘোষের ক্ষেত্রে যেটা তাঁরা বলতে পারেননি।
তা হলে মিঠুন কেন স্বেচ্ছায় পুরো টাকাটাই ফেরত দিচ্ছেন? জবাব দিতে চাননি মিঠুন। উত্তর দেননি এসএমএস-এরও। গত কয়েক দিন ধরে অসুস্থ তিনি। মাঝে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল। আপাতত বহির্বিশ্বের জন্য সেই অসুস্থতাকেই দেওয়াল হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। মুখ খুলতে চাইছেন না প্রকাশ্যে। সূত্রের খবর, ইডি-কে শুধু বলেছেন, ‘‘জানতাম না গরিবের টাকা নিয়ে এ ভাবে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। ওই টাকা আমি আমার পরিবারের জন্য খরচ করতে পারব না।’’ ঘনিষ্ঠ মহলে এও জানিয়েছেন, সারদার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে মিডিয়ায় যা সব লেখা হয়েছে, তাতে তিনি আহত। নিজের ভাবমূর্তি ফেরাতেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। জানিয়েছেন, এই টাকা রেখে দিলে বিবেকদংশন হতো।
বাস্তবিকই পর্দা এবং পর্দার বাইরে মিঠুনের ভাবমূর্তি বরাবরই পরোপকারী, গরিবের মসিহা গোত্রীয়। কলকাতার ছা-পোষা পরিবার থেকে মুম্বই গিয়ে তামাম ভারতকে ডিস্কো নাচিয়েছেন। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বক্স অফিসে ঝড় তুলেছেন। পরিণত বয়সেও বাংলায় কখনও গুরু থেকে মহাগুরু, কখনও এমএলএ থেকে মিনিস্টার ফাটাকেষ্ট অবতারে মারকাটারি সংলাপের তুবড়ি ছুটিয়েছেন। সেই লড়াকু, ন্যায়রক্ষকের চেহারায় সারদায় নাম জড়ানোটা বেমানান বলেই মনে করেছেন নায়ক। হাজার হোক এক কালে তাঁরই জনপ্রিয় সংলাপ ছিল, ‘ছোটা কাম হম করুঙ্গা তো উও কাম বহুত বড়া হো জায়েগা (জল্লাদ)!’ এক সময় দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা আয়কর দেওয়ার নজিরও গড়েছিলেন মিঠুন। তাঁকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বানিয়েছিল আয়কর দফতর। ব্যক্তিগত স্তরে মিঠুন জানিয়েছেন, তিনি সেই ইমেজটাই ফিরে পেতে চান। সেই জন্যই যেচে সারদার যাবতীয় টাকা ফেরত দিয়ে নিজের হাত পরিষ্কার রাখতে চাওয়া।
সারদার তদন্তে নেমে ইডি গত বছর জুলাইয়ে তাদের মুম্বই অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিল মিঠুনকে। তার পরে ফের গত মাসে কলকাতায় একটি গোপন ডেরায় বসে ইডি-র সঙ্গে কথা হয় তাঁর। তার পরেই টাকা ফেরানোর সিদ্ধান্ত। এত দিন সময় কেন নিলেন? ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, ইডি-র সঙ্গে প্রথম বার কথা বলার পরে মিঠুন ব্যক্তিগত ভাবে সারদা নিয়ে খোঁজখবর নেন। তার পরেই তিনি নিশ্চিত হন যে, এখানে ‘গরিব মানুষের টাকা নয়ছয়’ হয়েছে। তখন সেই টাকা আর নিজের জন্য রাখতে চাননি। সামনেই মুক্তি পাবে তাঁর নতুন ছবি ‘নকশাল’। সেখানে তিনি আদর্শবাদী বিপ্লবীর ভূমিকাতেই। রাজনৈতিক সূত্রে অনেকে এও বলছেন যে, সম্প্রতি তৃণমূলের থেকেও নিজের দূরত্ব রচনা করতে চাইছেন মিঠুন। এক কালে সিপিএমের সুভাষ চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত নায়ক তৃণমূলের টিকিটেই রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন। গত বছর লোকসভা নির্বাচনে গরমাগরম প্রচারও করেছিলেন। কিন্তু গত কয়েক মাস তাঁকে শাসক দলের ধারেকাছে দেখা যাচ্ছে না। নিয়মিত রাজ্যসভায় যাওয়াও বন্ধ করেছেন তিনি।
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ সব জল্পনা মানতে নারাজ। সচিন তেন্ডুলকর, লতা মঙ্গেশকর, রেখার উদাহরণ টেনে তিনি বলছেন, সেলিব্রিটিরা কোনও দিনই নিয়মিত সংসদে যান না। তার মানেই দূরত্ব নয়। পার্থবাবুর দাবি, ‘‘মিঠুনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে।’’
টাকা ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের কী প্রতিক্রিয়া? পার্থবাবু বললেন, ‘‘ভাল সিদ্ধান্ত। যখন নিয়েছিলেন ভাল বুঝে নিয়েছিলেন। এখন বুঝেছেন খারাপ, নেওয়া উচিত হয়নি।’’ তৃণমূলের আর এক সাংসদ অর্পিতা ঘোষেরও মত, ‘‘এটা ভাল সিদ্ধান্ত।’’ সারদায় নাম জড়িয়েছে অর্পিতার নিজেরও। তিনি সারদা মিডিয়ার উচ্চপদে চাকরি করেছিলেন চার মাস। তিনি সেই বেতন ফিরিয়ে দিতে চান। মিঠুনের মতো তিনিও গরিবকে ঠকিয়ে নেওয়া টাকা সঙ্গে রাখতে চান না। তাঁর মতে, এতে ‘গ্লানি’ বাড়ে।
মিঠুনের পদক্ষেপে খুশি বিরোধীরাও। অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায় এখন বিজেপিতে। তিনি বলছেন, ‘‘মিঠুনদার এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই টাকা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গরিবদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। যাঁরা ফেরত পেলেন, তাঁদের নাম-ঠিকানা-ছবি ছাপানো হোক ওয়েবসাইটে।’’ আর সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘মিঠুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তৃণমূলের বাকি যাঁরা টাকা নিয়েছেন, তাঁদেরও তা ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।’’