একমাত্র শিক্ষকের ভরসায় চলছে শালবনির ভুতাশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়। রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।
১৩৫ জন পড়ুয়ার স্কুলে শিক্ষক ছিলেন দু’জন। এক জনের গত সপ্তাহে বদলির নির্দেশ হয়েছে। অন্য জন চলতি মাসেই অবসর নেবেন। সঙ্কটে পশ্চিম মেদিনীপুরের বাবুইবাসা প্রাথমিক বিদ্যালয়।
আবার, মেদিনীপুর শহরের মুক্তারঞ্জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬১ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য আগে তিন জন শিক্ষক ছিলেন। এখন সেখানে নতুন চার জন শিক্ষক এসেছেন।
গত দেড় সপ্তাহে প্রায় বারোশো প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকা বদলির পরে পড়ুয়া-শিক্ষক অনুপাত এমনই দাঁড়িয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের বহু প্রাথমিকে। প্রায় দু’শো স্কুলে শিক্ষক এখন এক জন। অভিযোগ উঠেছে, শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নিরিখে বদলি করতে গিয়ে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে বিধি। ঘেঁটে গিয়েছে সামঞ্জস্য।
রাজনৈতিক রং দেখে বদলির অভিযোগ না মানলেও সমস্যা যে হচ্ছে, তা মেনেছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ কর্তৃপক্ষ। সংসদ চেয়ারম্যান স্বপন মুর্মু বলেন, “কিছু কিছু স্কুলের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। আসলে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হয়তো কিছু ভুল হয়েছে!”
তাড়াহুড়ো কেন?
স্বপনবাবুর বক্তব্য, “যে সব স্কুলে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শিক্ষক ছিলেন, সেখানে শিক্ষক কমানো হচ্ছিল। বদলে যে সব স্কুলে তুলনায় কম শিক্ষক ছিলেন, সেখানে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছিল। প্রায় বারোশো শিক্ষকের বদলি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সেটা দ্রুত করার চেষ্টা হয়েছিল।” এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বক্তব্য, “বিষয়টি জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট জেলার প্রাথমিক সংসদকে রিপোর্ট পাঠাতে বলেছি।”
পশ্চিম মেদিনীপুরে ৪৭০০টি প্রাথমিকে আগে স্থায়ী শিক্ষক ছিলেন প্রায় ১৪,৭০০ জন। পার্শ্বশিক্ষক ১,৪০০ জন। গত মাসে নতুন করে প্রায় ১,৫০০ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। জেলায় প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সাড়ে ৩ লক্ষের কিছু বেশি। আগে নিয়ম ছিল, স্কুলে ৪০ জন ছাত্রপিছু এক জন করে শিক্ষক থাকবেন। বর্তমানে ৩০ জন ছাত্রপিছু এক জন করে শিক্ষক থাকার কথা। সংসদের নিয়মানুযায়ী, কোনও স্কুলে বাড়তি শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকলে সেখান থেকে প্রয়োজনে তাঁদের অন্যত্র পাঠানো যেতে পারে। নিয়ম মানা হলে সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। অথচ, গত ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে যে বদলি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার জেরে কোথাও পড়ুয়ার অনুপাতে শিক্ষক বেশি, কোথাও আবার স্কুল চলছে মাত্র এক জন শিক্ষক দিয়ে।
পড়ুয়া অনুপাতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা হিসেব করে বদলি প্রক্রিয়া কার্যকর করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন সংসদ চেয়ারম্যান। অথচ, মেদিনীপুর শহরের সাহাভড়ংবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৬ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন ছ’জন। শহরের অজয় বিদ্যাপীঠে চলতি শিক্ষাবর্ষে কোনও ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়নি। এই স্কুলে শিক্ষক অবশ্য আছেন দু’জন।
পক্ষান্তরে, শালবনির ভুতাশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া রয়েছে ৪১ জন। দু’জন স্থায়ী শিক্ষক ছিলেন। গত সপ্তাহে দু’জনই বদলি হয়েছেন। এখন স্কুল চালাচ্ছেন এক জন মাত্র পার্শ্বশিক্ষক ভক্তিপদ মাহাতো। তিনি প্রতিবন্ধী। সোমবার স্কুলে গিয়ে দেখা গেল পাঁচটি শ্রেণিকক্ষের তিনটি বন্ধ। ভক্তিপদবাবু বলেন, “ঘর খুলে কী হবে? আমি তো একা। দু’টো ঘরেই ভাগাভাগি করে ছেলেমেয়েদের বসতে বলেছি।” নিয়মের তোয়াক্কা না করে শুধু স্বজনপোষণের জন্য যথেচ্ছ বদলি করা হয়েছে অভিযোগে সরব হয়েছে এবিপিটিএ। ওই বামপন্থী শিক্ষক সংগঠনের জেলা সম্পাদক সত্যেন বেরা বলেন, “বদলির সময় স্কুলের সমস্যা দেখা হয়নি, শুধু দেখা হয়েছে যিনি বদলির আবেদন করেছেন, তিনি তৃণমূলপন্থী কি না। ফলে, সমস্যা চরম আকার নিয়েছে।” বাম-বিরোধী সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’র জেলা সম্পাদক তপন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বচ্ছতা-সততা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে তৃণমূলের কারও কারও স্বচ্ছতা-সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।” ‘‘বদলি নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে’’, বলে মানছেন ‘পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’র জেলা নেতা তপন উত্থাসিনীও।
বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে স্কুলশিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরাও। শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, অনেক অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক (এসআই) বদলির নির্দেশ পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ‘রিলিজ অর্ডারে’ সই করতে চাইছেন না। এক বিদ্যালয় পরিদর্শকের কথায়, “এ ভাবে বদলি হলে প্রাথমিকের পড়াশোনা শিকেয় উঠবে। অভিভাবকেরা চটে যাবেন। ক্ষোভের মুখে তো পড়তে হবে আমাদের।” ‘পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যালয় পরিদর্শক সমিতি’র জেলা সাধারণ সম্পাদক পূর্ণেন্দু উত্থাসিনী অবশ্য বলেন, “লোকসভা ভোট ঘোষণা হয়েছে তো। তাই হয়তো কেউ কেউ ‘রিলিজ অর্ডারে’ সই করতে চাইছেন না।”