মেদিনীপুর পুরভবন। —ফাইল চিত্র।
সেটা ১৮৬৫ সাল। স্বাধীনতার ৮২ বছর আগে ওই বছরই ইংরেজরা মেদিনীপুরকে পুরসভা বানিয়েছিল। পায়ে পায়ে দেড়শো বছর বয়স হল সেই পুরসভার!
গত ১ এপ্রিল দেড়শোয় পা দিয়েছে মেদিনীপুর পুরসভা। ভোটের বাজারে অবশ্য নিঃশব্দেই পেরিয়ে গিয়েছে ঐতিহাসিক এই মুহূর্ত। কোনও অনুষ্ঠানই হয়নি। পুরপ্রধান প্রণব বসু বলেন, “ লোকসভা ভোট মিটলে আমলা সার্ধ্বশতবর্ষ উদ্যাপন করব।” অনুষ্ঠান না হলেও মেদিনীপুরবাসীর কাছে এ এক রোমাঞ্চের মুহূর্ত, গর্বের মুহূর্ত। শহরের সাধারণ নাগরিক থেকে পুরপ্রধান, দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, সকলেরই এক অনুভূতি। তৃণমূলের পুরপ্রধান প্রণববাবুর বক্তব্য, “সত্যিই এ এক দারুণ মুহূর্ত। এমন সময়ে পুরপ্রধান পদে থাকায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।” কংগ্রেসের প্রবীণ কাউন্সিলর শম্ভুনাথবাবু বলেন, “কঠিন লড়াইয়ে দিতে এ বার কাউন্সিলর হয়েছি। হয়তো দেড়শো বছরের সাক্ষী থাকার জন্যই।”
সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপনে বছরভর নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করতে প্রস্তুতি কমিটি গড়া হচ্ছে। তবে পুরসভার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে হতাশ হতে হচ্ছে। কারণ, ১৯১৮ সালের আগের কোনও তথ্যই মিলছে না। ওই সময়কালে কে পুরপ্রধান ছিলেন, পুরসভার ওয়ার্ড সংখ্যা কত ছিল, কী ভাবে পুরসভা চালানো হত এ সব বিষয় অন্ধকারে। ১৯১৮ সালে পুরপ্রধান ছিলেন বাবু উপেন্দ্রনাথ মাইতি। তখন পুরসভার ৬টি ওয়ার্ড ছিল। ১৯১৮ সাল থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত যত জন পুরপ্রধান হন সকলেই বাঙালি। তবে সাধারণ পেশাদার বাঙালি নন। বাবু, রায় উপাধিধারীরাই পুরপ্রধান পদে আসীন ছিলেন। ১৯৫১ সালে প্রথম সেই প্রথা ভেঙে এক চিকিৎসক পুরপ্রধান হন। তিনি হলেন গজেন্দ্রনাথ সিংহ।
মেদিনীপুর শহর অতি প্রাচীন। এই শহরে নলবাহী পানীয় জল সরবরাহ শুরু হয়েছিল সেই ১৯২৪ সালে। শহরে এক সময় ঘোড়ায় টানা ট্রামও চলত। তখন জলপথ যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলেও কাঁসাই থেকে শহরের অন্য প্রান্তে মালপত্র নিয়ে যেতে ইংরেজরা ট্রামলাইন পেতেছিল। অতীত ঐতিহ্যের নানা তথ্যই অবশ্য যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও যেখানে ই-মেল, ফেসবুকের দাপট, সেখানে এখনও মেদিনীপুর পুরসভার ওয়েবসাইট তৈরি হয়নি। সার্ধ্বশতবর্ষে সেই কাজের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ভার দেওয়া হয়েছে তরুণ কাউন্সিলর নির্মাল্য চক্রবর্তীকে। নির্মাল্যবাবুর কথায়, “পুরসভা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। একে তো ১৯১৮ সালের আগের কোনও তথ্য নেই। পরবর্তীকালের তথ্যও সে ভাবে গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করা নেই।” পুরপ্রধান বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি, যত বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করে ওয়েবসাইটে দেওয়ার।”
বর্তমানে পুরসভায় ২৫টি ওয়ার্ড। শহরের পরিসরও বেড়েছে অনেক। নতুন নতুন এলাকায় জনবসতি তৈরি হয়েছে, বাজার গড়ে উঠেছে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়েছে। এ বার অবশ্য হাট-বাজার থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরসভার যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য ওয়েবসাইটে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পুরসভার কাজকর্ম, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও তুলে ধরা হবে নিয়মিত। পুরপ্রধান জানান, দেড়শো বছর উপলক্ষে ১ এপ্রিল থেকেই বছরভর নানা ধরনের অনুষ্ঠান হবে। এই অনুষ্ঠানে শহরের সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণও থাকবে।
হয়তো বড়মাপের অনুষ্ঠান হবে। নেতা-মন্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষের ভিড়ও হবে জমজমাট। এ তো একটা দিক। তারই সঙ্গে এ প্রশ্নও তো উঠবে, দেড়শো বছরে কতটা এগিয়েছে পুরসভা। পুরনাগরিকেরা কী এখনও উপযুক্ত পরিষেবা পান? এখনও শহরে ঢোকার আগেই বৃহৎ আবর্জনা ফেলার জায়গাটি থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। শহরে ঢোকার আগেই মানুষকে বুঝিয়ে দেয়, দুরবস্থার কথা। বারবার ‘সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর মাধ্যমে আবর্জনাকে কাজে লাগাবার পরিকল্পনা করেও সুফল মেলেনি। শহরে সর্বত্র পর্যাপ্ত পানীয় জল এখনও অধরা। রাস্তাঘাটের অবস্থাও তথৈবচ। আর বেহাল নিকাশি নালার কথা তো সকলের জানা। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা ডুবে যায়। পুরপ্রধান অবশ্য জানিয়েছেন, ধীরে ধীরে এই সব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হচ্ছে পুরসভা।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত হয়েছে কী? দেড়শো বছর পূর্তির আগে রাস্তা সারােু টাকা পেয়েছিল পুরসভা। সেই ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকায় ২৭টি ছোট-বড় রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হবে। যে সব এলাকায় তীব্র জল সঙ্কট সেখানে ১০টি গভীর নলকূপও বসানোর বরাদ্দ মিলেছে। তবে কোথায় বসানো হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। এলআইসিচক ও বিধাননগর এলাকায় উড়ালপুলের সামনে সৌন্দর্যায়ন করা হয়েছে। হরিজনপল্লিতেও এমন একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ব্যস, এটুকুই। তাই শহরবাসী চান, ধুমধাম করে দেড়শো বছর পালিত হোক। কিন্তু তারই সঙ্গে প্রাচীন এই পুরসভার ঐতিহ্য ধরে রাখতে উন্নয়নের কাজও হোক একটু বেশি। যাতে শহরবাসী উপযুক্ত পরিষেবা পান। তা হলেই প্রাচীন পুরসভা গৌরব অটুট থাকবে।