পাশাপাশি মোদী-মমতা। জেলা পরিষদের কাছে এই চা দোকানে মোদীর শপথের দিনেও সৌজন্যের ছবি দেখা গেল। বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা তর্ক-বিতর্কের মাঝেই হাসিমুখে লাড্ডু খেলেন। —নিজস্ব চিত্র।
দ্বন্দ্ব রয়েছে। রয়েছে বিতর্ক। কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব কখনও একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয় না। বরং হেরে গিয়েও একজন অন্যের পিকনিকে হাজির থেকে কব্জি ডুবিয়ে মাংস-ভাত খান। জয়ের খুশিতে বাজানো গান শোনেন।
বাম আমল থেকেই এই সৌজন্যের রাজনীতি চলে আসছে জেলা পরিষদ গেটের ঠিক উল্টোদিকের চা দোকানে। এখানে পতাকা না দেখলে বোঝাই যাবে না, কোন দলের উৎসব হচ্ছে, কারা মাইক বাজাচ্ছেন, কারাই বা মিষ্টি বিলি করছেন। এখানে মমতা-মোদীর ছবি পাশাপাশি থাকে। চায়ের দোকানে ছাউনির ফাঁকে উঁকি মারে কাস্তে-হাতুড়ি-তারাও। সিপিএমের শাখা সম্পাদক সুন্দরম সিংহরায়, বিজেপি-র শহর সভাপতি শুভজিৎ রায়, তৃণমূলের জেলা যুব সাধারণ সম্পাদক তুহিন ভট্টাচার্য থেকে অনেক ছোটবড় নেতা-কর্মী এখানেই বসেই আড্ডা মারেন। সঙ্গে চলে ঘন ঘন চা।
এখানে বসে সুন্দরমবাবু হয়তো বললেন, “বিজেপি তো এলো। এতে কী আদৌ রাজ্যের উন্নতি হবে? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো সম্পর্কই নেই।” তাঁকে সমর্থন করে কেউ বলে বসলেন, “ঠিক বলেছো সমুদা (সুন্দরমবাবুর ডাক নাম)। এবার রাজ্যকে যা টাইট দেবে না মোদী।” তৃণমূল নেতা তুহিন ভট্টাচার্য তখন চিৎকার করে উঠলেন, “এতো সহজ নয়। চৌত্রিশ বছরের জগদ্দল পাথরকে সরিয়েছে দিদি। ভুলে গেলে চলবে না। এত দেনা নিয়ে কী ভাবে রাজ্যে কাজ করছে দেখতেই তো পাচ্ছ। ওসব মোদী-টোদী দেখিও না।” পাশ থেকে তাঁর সমর্থনে কেউ বলে বসলেন, “পিন্টু (তুহিনের ডাক নাম) ঠিক বলেছে। দিদিকে মোদী দেখিও না। এখন ক’দিন হইহই হবে। তারপর আর কেউ কোত্থাও থাকবে না। শুধু দিদিই থাকবে।” একজন টিপ্পনি কেটে বললেন, ”কীরে বান্টি (শুভজিতের ডাক নাম)? রাজ্যে তাহলে তোরা কিছুই করতে পারবি না নাকি?” অমনি বিজেপি নেতা শুভজিৎ তেড়ে এলেন, “দেখা যাবে দেখা যাবে, ক’দিন যেতে দাও। এখনই তো লাইন লেগে গিয়েছে। বাঁধ ভাঙা জলের মতো হু হু করে সবাই আসতে চাইছে। আমরা একটু সময় নিচ্ছি। বেনো জল ঢোকাব না বলে।”
এই চা দোকানে উচ্চগ্রামে বিতর্ক চলে রোজই। কেউ হারতে রাজি নয়। কিন্তু থামতে তো হবে। চিৎকার করতে করতে গলা যে শুকিয়ে গেল। ওমনি চা হাজির। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফের শুরু হল বিতর্ক।
তবে এই বিতর্ক কখনওই শত্রুতায় পরিণত হয় না। চায়ের আড্ডা থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে কেউ মতপার্থক্যের কথা মনেও রাখেন না। প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর শপথ গ্রহণের দিনও বজায় থাকল এই সৌজন্যের ছবি। সোমবার সকলে মিলে লাড্ডু খেলেন। বিজেপি-র উদ্যোগে বসানো জায়েন্ট স্ক্রিনে মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানও দেখলেন।
সিপিএম নেতা সুন্দরমবাবুর কথায়, “রাজনীতিতে নীতির লড়াই। তার জন্য নিজেরা বিবাদে জড়াবো কেন? প্রতিদিন এক সঙ্গে চা না খেলে, তর্ক না করলে ভালই লাগে না।” বিজেপি-র শুভজিৎবাবুর বলেন, “দলের কথা বলার জন্য রাজনৈতিক মঞ্চ রয়েছে। তার বাইরে বিবাদ টেনে আনব কেন।” তৃণমূলের তুহিনবাবুর গলাতেও সেই সৌজন্যের সুর, “আমাদের এখানে তর্ক চলে। তবে তা থেকে কোনওদিন কেউ বিবাদে জড়ায়নি। একজনের সুখে সকলে যেমন আনন্দ পেয়েছি, দুঃখে কষ্ট পেয়েছি, পাশে থেকেছি।”
এমন সহাবস্থান বিরল। তবে রাজনীতির আঙিনায় এমন ছবিই যে সকলে দেখতে চায়।