নিহত নারায়ণ।
রেলশহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা পরেও খুনের কারণ নিয়ে ধন্দে পুলিশ।
সোমবার রাতে খড়্গপুরের চৌরঙ্গির কাছে দুষ্কৃতীদের গুলিতে মৃত্যু হয় নারায়ণ চন্দ (৪৫) নামে এক ব্যক্তির। তিনি ইন্দার বাসিন্দা। ওই ঘটনায় জখম নারায়ণবাবু ও তাঁর ভাগ্নে ডেবরার লোয়াদার বাসিন্দা শুভম সিংহকে প্রথমে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা নারায়ণবাবুকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় শুভমকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। খড়্গপুরের মহকুমা পুলিশ আধিকারিক অজিতসিংহ যাদব বলেন, “জমি সংক্রান্ত বিষয় বিষয় এই খুনের পিছনে রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।”
স্থানীয় ও পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ মোটরসাইকেলে ভাগ্নে শুভমকে নিয়ে নারায়ণবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ভাগ্নের কাজের জন্য একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন বলে তিনি বাড়ির লোকেদের জানান। ওই ঘটনার সাক্ষী শুভম পুলিশকে দেওয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছে, এ দিন রাত ৯টা নাগাদ চৌরঙ্গির কাছে মোরাম রাস্তা ধরে বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকের দিকে যাওয়ার পথেই ওই ঘটনাটি ঘটে। অন্ধকারে মোরাম রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে আচমকা রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে কেউ বা কারা ঘুষি মেরে মোটরসাইকেল থেকে তাঁদের ফেলে দেয়। তারপরই শুরু হয় এলোপাথারি গুলি। নারায়ণবাবুর বুকে ও মাথায় গুলি লাগে। শুভমের বুকের পাশে গুলি লাগে। গুলি চালিয়ে মুখে কাপড় বাঁধা দুষ্কৃতীরা পালায়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাঁদের দু’জনকে উদ্ধার করে প্রথমে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানেই নারায়ণবাবুকে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। শুভমকে প্রথমে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। মঙ্গলবার সকালে খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে নারায়ণবাবুর দেহের ময়না-তদন্ত করা হয়।
মঙ্গলবার ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দু’টি গুলির খোল উদ্ধার করেছে। পুলিশের অনুমান, মুঙ্গেরে তৈরি ৯ এমএম পিস্তল দিয়ে খুব কাছ থেকে তাঁদের লক্ষ করে গুলি চালানো হয়েছিল। নারায়ণবাবু ও শুভমের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা করে তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। তবে এই খুনের পিছনে কারা রয়েছে, সেই বিষয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নারায়ণবাবুরা দুই ভাই। বড় ভাই টায়ারের ব্যবসা করেন। বিদ্যাসাগর শিল্পতালুক থেকে কিছুটা দূরে জফলা রোডে নারায়ণবাবুদের প্রায় একশো ডেসিমেল জমি রয়েছে। ওই জমিতে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী একটি বেসরকারি সংস্থা কিছুদিন ধরেই স্থানীয় দালাল মারফত নারায়ণবাবুদের উপর জমি বিক্রির জন্য চাপ সৃষ্টি করছিল বলে অভিযোগ। নারায়ণবাবুর স্ত্রী পিউদেবী বলেন, “এই খুনের ঘটনায় আমার কাউকে সন্দেহ হয় না। তবে কয়েকদিন ধরেই শুনছিলাম আমাদের জমিতে রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা লাগানো হয়েছে, তা নিয়ে চিন্তা ছিল। তবে যারা আমার এই সর্বনাশ করল, তাদের শাস্তি চাই।” ওই জমিতে তৃণমূলের ঝান্ডা লাগানো ছিল বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। যদিও খড়্গপুর গ্রামীণ থানার পুলিশ জানিয়েছে, ওই খুনের ঘটনায় জমিতে ঝান্ডার বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তৃণমূলের খড়্গপুর ১ ব্লকের সভাপতি শক্তি মণ্ডল বলেন, “ওই জমিতে তৃণমূলের ঝান্ডা লাগানো ছিল কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই বলে শুনেছি।”
শোকাহত নারায়ণ চন্দের পরিবার।
পুলিশের অনুমান, শুভমের কাজের প্রয়োজন থাকায় জমির দালালরা ওই জমির বিনিময়ে টাকার সঙ্গে শুভমের চাকরির টোপও দেন। পরিবার সূত্রে খবর, গত ১৫ এপ্রিল শুভমের কাজের জন্যই নারায়ণবাবু ভাগ্নেকে নিয়ে বিদ্যাসাগর শিল্প তালুকে কারও সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু তাদের দেখা না পেয়ে তাঁরা ওই দিন ফিরে আসেন। গত রবিবারও তাদের সঙ্গে নারায়ণবাবুদের দেখা করার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে তা বাতিল করা হয়। তবে সোমবার নির্ধারিত সময়ে নারায়ণবাবু ভাগ্নকে নিয়ে ফের ওই লোকেদের সঙ্গে দেখা করতে যান।
পারিবারিক সূত্রে খবর, শুভম ডেবরা কলেজের ছাত্র। পড়াশোনার ফাঁকে সে মামার বাড়িতে থেকে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণও নিত। পুলিশকে শুভম জানায়, এ দিন মামা কাজের ব্যাপারে একজনের সঙ্গে দেখা করাবে বলে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। সোমবার রাতে বাড়ি থেকে বেরনোর পর ওঁরা ফোন করে দু’বার দেখা করার জায়গা বদল করে। তৃতীয়বার ফোন করে বিদ্যাসাগর ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্কের কাছে দেখা করবে বলে জানায়। সেইমতো আমরা ওই ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্কের কাছে দেখা করতে যাওয়ার পথেই ওই ঘটনা ঘটে। পিউদেবী বলেন, “শুভম মাস দু’য়েক আগে আমাকে কাজের কথা বলে। আমি ওঁর মামাকে বিষয়টি বলেছিলাম। তারপর থেকেই শুভমের কাজের ব্যাপারে ওঁর মামা চেষ্টা চালাচ্ছিল।” শুভমের মা প্রতিমা সিংহ বলেন, “আমার স্বামী চাষবাস করেন। ছেলেটার চাকরির জন্যই শুভম এ দিন মামার সঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু যাঁরা এই কাণ্ড করল তাঁদের খুঁজে বের করা হোক।”
ভোটের একদিন আগে এই খুনের ঘটনা ঘিরে এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। সিপিএমের জোনাল সম্পাদক কমল পলমল বলেন, “এই খুনের সঙ্গে হয়তো জমি সংক্রান্ত বিষয়ই জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে এই খুনের ঘটনায় এলাকার মানুষ শঙ্কিত।” খড়্গপুরের মহকুমা পুলিশ আধিকারিক বলেন, “নির্বাচনের জন্য সর্বত্রই কঠোর নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।”
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।