ঝাড়গ্রামের বেহাল দেবেন্দ্রমোহন হল।
সময়টা নব্বইয়ের দশক। ঝাড়গ্রামের এক সিনেমা হলে ঠাসাঠাসি ভিড়। মাঝরাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়....’ গানের কলি ধরেছেন আরতি মুখোপাধ্যায়! মুগ্ধ হয়ে শুনছেন শ্রোতারা। শরতের সেই রাতে সিনেমার-শো বন্ধ করে ওই প্রেক্ষাগৃহে গানের জলসা হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের কাছে গায়িকা জানতে চেয়েছিলেন, কেন সিনেমা হলে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে? উদ্যোক্তারা শিল্পীকে জানিয়েছিলেন, ঝাড়গ্রামে বড় কোনও সাংস্কৃতিক মঞ্চ বা অডিটোরিয়াম না থাকায় সিনেমা হল ভাড়া করতে হয়েছে।
তারপর পেরিয়ে গিয়েছে দু’দশক। কিন্তু এতদিনেও ছবিটা একটুও বদলায়নি অরণ্য শহরে। উল্টে আরও বেহাল হয়েছে অবস্থা। শহরের সব ক’টি বন্ধ সিনেমা হলগুলির অবশ্য এখন ভুতুড়ে দশা। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় শিল্পকলা সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে ধরা হয় ঝাড়গ্রামকে। কিন্তু অরণ্যশহরে শিল্পচর্চার বহিঃপ্রকাশের জন্য উপযুক্ত কোনও মঞ্চ বা অডিটোরিয়াম নেই।
উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক মঞ্চ বলতে রয়েছে সবেধন নীলমণি---সেই আদ্দ্যিকালের ‘দেবেন্দ্রমোহন হল’ ওরফে ‘ডিএম হল’। মঞ্চটি শহরের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় অনুষ্ঠানের জন্য এই হলকেই বেছে নিতে বাধ্য হন সবাই। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, একটি বেসরকারি সংস্থার অধীনে থাকা ওই হলে কোনও পরিকাঠামো নেই। হলের দু’দিক ঘেঁষে বাড়িঘর ও ফ্ল্যাট হয়ে গিয়েছে। ফলে, বাতাস চলাচলের জায়গা নেই। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা হয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হলে বিদ্যুত্ সংযোগের অবস্থাও খুবই খারাপ। হল ভাড়া নেওয়ার পর উদ্যোক্তাদেরই চেয়ার, আলো, মাইক ও জেনারেটরের ব্যবস্থা করতে হয়। এক দিনের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রির অবস্থা হয়। ডিএম হলের মঞ্চ ও সাজঘরটিরও বেহাল দশা। বাম পুরবোর্ডের আমলে বছর দেড়েক আগে শহরের বাছুরডোবায় পুরসভার একটি টাউন হল তৈরি হয়েছে। সেখানেও চেয়ার নেই। সাউন্ড সিস্টেমে ত্রুটি রয়েছে। পরিকাঠামোগত অনেক কাজই বাকি।
তবে অরণ্যশহরে শিল্পচর্চার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ‘ঝাড়গ্রাম আর্ট আকাডেমি’র যে নিজস্ব মঞ্চ ও গ্যালারি রয়েছে সেটি কেবলমাত্র সংস্থার নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। আর্ট আকাডেমির অধ্যক্ষ সঞ্জীব মিত্র বলেন, “আমরা এক ছাদের তলায় কাজ করার জন্য নিজেদের উদ্যোগে মঞ্চ ও গ্যালারি তৈরি করি।” সঞ্জীববাবুও মানছেন, অরণ্যশহরে বড় মঞ্চ বা অডিটোরিয়ামের অভাব রয়েছে। ঝাড়গ্রামের বলাকা সাংস্কৃতিক চক্রের ‘বলাকা মঞ্চ’টি অবশ্য অন্যদের ভাড়া দেওয়া হয়। তবে বলাকা মঞ্চটি শহরের একপ্রান্তে এবং আসনও সীমিত।
এক সময় ঝাড়গ্রাম শহরে ১৪টি নাটকের দল ছিল। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পুরনো ও নতুন দল টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছে। আট বছরের নাটকের দল ‘কথাকৃতি’র বেশ কিছু নাটক সর্বভারতীয় স্তরে পুরস্কৃত-প্রশংসিত হয়েছে। ‘কথাকৃতি’র উদ্যোগে ছোটদের নাটক শেখানোর ক্লাসও হয়। ‘কথাকৃতি’র কর্ণধার কুন্তল পালের আক্ষেপ, “এখানে উপযুক্ত মঞ্চ নেই। স্পনসর করার মতো বাণিজ্যিক সংস্থা নেই। প্রতিভা প্রকাশের জায়গা ও আর্থিক দিকটা সুনিশ্চিত না হলে কেন জঙ্গলমহলের নতুন প্রজন্ম নাটক ও শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে বেছে নেবে, বলুন তো?” ঝাড়গ্রাম শহরে ‘মৃদঙ্গ’, ‘নিক্কণ’, ‘নৃত্যাঙ্কন’, ‘ছন্দক’, ‘নৃত্যশ্রী’, ‘নৃত্যধারা’র মতো কয়েকটি নৃত্য-প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সঙ্গীত বা যন্ত্রসঙ্গীত শেখার জন্য ‘গীতসুধা, ‘সুরছন্দা’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘সুরশ্রী মিউজিক কলেজ’-এর মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ‘আর্টস্ হেভেন’ ও ‘কোলাজ’-এর মতো একাধিক অঙ্কন ও শিল্পকলা সংস্থা রয়েছে। ‘আনন্দন’, ‘প্রয়াস’, ‘রূপক’, ‘কথাকৃতি’র মতো নাটকের দলগুলি নিয়মিত নাটক প্রযোজনা করছে। কিন্তু সবার সেই একই সমস্যা।
শিল্পীতীর্থ শিক্ষানিকেতনের অধ্যক্ষ সুখময় শতপথী বলেন, “জঙ্গলমহল নাকি মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় জায়গা। তাহলে অরণ্যশহরে একটা বড় আধুনিক মঞ্চ গড়ার কথা তিন বছরেও ভাবা হল না কেন? অডিটোরিয়ামের সমস্যার জন্য আমরা প্রতি বছর শহরের অফিসার্স ক্লাব মাঠে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে বার্ষিক অনুষ্ঠান করি।” মৃদঙ্গ নৃত্য সংস্থার কর্ত্রী তথা প্রবীণ নৃত্যশিল্পী গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ডিএম হলের অপরিসর মঞ্চের মেঝেটি কাঠের নয়, শান বাঁধানো। এমন মঞ্চে ঝুঁকি নিয়েই নৃত্য পরিবেশন করতে হয়।” শহরের বিশিষ্ট ঝুমুর সঙ্গীতশিল্পী তথা ‘ঝাড়গ্রাম একাসা’ সংস্থার পরিচালিকা ইন্দ্রাণী মাহাতোর বক্তব্য, “উপযুক্ত মঞ্চ না থাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন দর্শক-শ্রোতারা।”
সাড়ে তিন দশকের পুরনো নাটকের দল ‘আনন্দন’-এর পরিচালক সঞ্জীব সরকার বলছেন, “সবার আগে জঙ্গলমহলে শিল্পচর্চার জন্য ঝাড়গ্রাম শহরে একটি উপযুক্ত আধুনিক মঞ্চ বা অডিটোরিয়াম দরকার। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ জরুরি।” এই বিষয়ে কী বলছে প্রশাসন? ঝাড়গ্রামের পুরপ্রধান দুর্গেশ মল্লদেব বলেন, “শহরে প্রায় হাজার আসন বিশিষ্ট একটি অত্যাধুনিক বড় মঞ্চ তৈরির চিন্তা ভাবনা চলছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের সঙ্গে আমরা আলোচনা চালাচ্ছি।”
ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
কেমন লাগছে আমার শহর? আপনার নিজের শহর
নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-ঝাড়গ্রাম’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’,
মেদিনীপুর বিভাগ,
জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা- ৭০০০০১