কাঁথি

ভ্যানই ভরসা, যন্ত্রণাও সেই ভ্যান

কাঁথি তো ভ্যান-রিকশার শহর! এলাকার বাইরে থেকে আসা মানুষেরা এ নামেই সম্বোধন করেন পূর্ব মেদিনীপুরের মহকুমা শহর কাঁথিকে। সেই কাকভোর থেকে শুরু হয় প্যাঁক প্যাঁক, বিরামহীন ভাবে চলে রাত প্রায় একটা পর্যন্ত! সঙ্গে উপরি হিসাবে রয়েছে যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি, মায় বচসা। শহরবাসীর কথায়, যানজটের কাঁথিতে ভ্যান-রিকশা যেন বোঝার উপর শাক থুড়ি, দুর্ভোগের আঁটি!

Advertisement

সুব্রত গুহ

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৪১
Share:

কাঁথি শহরের সুপার মার্কেটের সামনের রাস্তায় ভ্যানের দাপটে চলাই দায়।

কাঁথি তো ভ্যান-রিকশার শহর! এলাকার বাইরে থেকে আসা মানুষেরা এ নামেই সম্বোধন করেন পূর্ব মেদিনীপুরের মহকুমা শহর কাঁথিকে। সেই কাকভোর থেকে শুরু হয় প্যাঁক প্যাঁক, বিরামহীন ভাবে চলে রাত প্রায় একটা পর্যন্ত! সঙ্গে উপরি হিসাবে রয়েছে যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি, মায় বচসা। শহরবাসীর কথায়, যানজটের কাঁথিতে ভ্যান-রিকশা যেন বোঝার উপর শাক থুড়ি, দুর্ভোগের আঁটি!

Advertisement

রাজ্যের অন্যতম সৈকত পর্যটনকেন্দ্র দিঘার পথে ১৪.২৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কাঁথিতে দিনে কম করেও চার থেকে পাঁচ হাজার ভ্যান-রিকশা চলে। শহর সংলগ্ন বিভিন্ন পঞ্চায়েত থেকেও কয়েক’শো ভ্যান-রিকশা যাত্রী, পণ্য নিয়ে দিনভর যাতায়াত করে। রয়েছে অন্য নানা যানবাহনও। অভিযোগ, অপরিসর রাস্তায় পুর-নিয়ন্ত্রণহীন সেই যান চলাচলে ফলে যানজট শহরের রোজনামচা।

পরিস্থিতি সামলাতে বহু দিন হল সকাল ৭টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত শহরের ভেতর দিয়ে বাস ও ভারি যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সময়ে প্রায় দু’দশক আগে তৈরি হওয়া কাঁথির বাইপাস দিয়ে যাবতীয় গাড়ি চলাচলের কথা। অভিযোগ, নিষেধের তোয়াক্কা না করে বেশ কয়েক’টি রুটের বাস দিনেও শহরের মধ্যে দিয়ে হামেশাই যাতায়াত করে। ফলে পুরসভার তরফে যান নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক থাকলেও সমস্যার বদল হয় না বলেই শহরবাসীর অভিযোগ।

Advertisement

কেমন? স্থানীয় বাসিন্দা তথা সমবায় ব্যাঙ্কের পদস্থ আধিকারিক অ্যাপোলো আলির কথায়, বাড়ি থেকে ব্যাঙ্কের দূরত্ব এক কিলোমিটার মত। মোটর বাইকে এটুকু যেতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। তিনি বলছেন, “এতেই বোঝা যায় ব্যস্ত সময়ে শহরের যানজট কতটা তীব্র!” কাঁথি বাজার বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সুজিত মাইতি বলছেন, “সব সময়ই সরু ঘিঞ্জি রাস্তার উপরেই ব্যবসায়ীরা লরি থামিয়ে দোকানের মাল ওঠায়-নামায়। রাস্তা জুড়ে কেউ কেউ দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখায় পথ চলা যায় না। অনেক দোকানে ঢোকা বের হওয়াও দায়!” একই অভিযোগ দারুয়া এলাকার বাসিন্দা প্রাথমিক শিক্ষক অনুকূল বেরা, ধর্মদাসবাড় মৌজার চিত্তরঞ্জন পাহাড়িদের।

যানজটের ফাঁসে নাভিশ্বাস পোস্ট অফিস মোড়েও।

শহরের বাসিন্দাদের মত, ক্যানাল পার থেকে পোস্ট অফিস মোড়, সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড, রাজাবাজার হয়ে চৌরঙ্গী মোড়, জুনপুট মোড় থেকে সুপার মার্কেটের সামনে দিয়ে কাঁথি থানা, মহকুমাশাসকের অফিস থেকে মহকুমা হাসপাতাল যাওয়ার রাস্তায় সব চেয়ে বেশি যানজট হয়। তাতে প্রায়ই আটকায় স্কুলবাস, অ্যাম্বুল্যান্স থেকে দমকলের গাড়ি। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ তো রয়েইছে।

কাঁথির প্রধান দু’তিনটি রাস্তার ধারেই রয়েছে বহু অফিস, আদালত থেকে শুরু করে হাট-বাজার, হাসপাতাল, নার্সিংহোম। রয়েছে ব্যাঙ্ক, বিমা অফিস, স্কুল-কলেজ, দমকল মায় পোস্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। ১৮৫২ সালে মহকুমা শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা এমন জায়গায় এত দিনেও যান নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি কেন?

পুরপ্রধান তৃণমূলের সৌমেন্দু অধিকারীর জবাব, “অপরিসর রাস্তার কারণেই এই যানজট। রাস্তার দু’ধারে দোকানপাট, সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি থাকায় তা সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না।” কবে এই বেআইনি দখলদারদের হঠানো হবে? পুর-কর্তৃপক্ষের থেকে সদুত্তর মেলেনি। একই সঙ্গে সৌমেন্দুবাবু জানাচ্ছেন, “পুরসভা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। স্কুল-কলেজ কিংবা অফিসের সময়ে পুরকর্মী ও স্বেচ্ছা সেবকেরা যান নিয়ন্ত্রণ করেন। শহরের বেশ কিছু প্রধান রাস্তায় যান চলাচল একমুখী করা হয়। বাদ যায় না রিকশাও।” শহরবাসীর একাংশ তা মানলেও তাঁদের অভিযোগ, পুর-নজরদারি শেষ হলেই ফের শহর জুড়ে দেখা যায় যানজটের সেই চেনা ছবি।

এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা যে ভাবে শহরের রাস্তায় পণ্য নামিয়ে ব্যবসা করছেন, সেটা বন্ধ করা গেলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতে পারে, মত পুরসভার তৃণমূলের কাউন্সিলর তথা দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ক দিব্যেন্দু অধিকারীর। তিনি বলেন, “পুরসভার পক্ষ থেকে কয়েক বার রাস্তার উপর ব্যবসায়ীদের পণ্যসামগ্রী রাখার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হলেও কয়েক দিন গেলে যে কে সেই!” এটা পুরসভারই ব্যর্থতা নয় কি, প্রশ্ন এক শহরবাসীর।

কাঁথি পুরসভার জন্ম ১৯৫৮ সালে। ৯ থেকে ওয়ার্ড সংখ্যা এখন বেড়ে হয়েছে ২০। জনসংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি। প্রতিদিনই শহরে মাথা তুলছে নতুন নতুন বাড়ি। পুরসভা গঠনের আগেই এই শহরে অপরিকল্পিত ভাবে তৈরি হয়েছিল বেশ কিছু বাড়িঘর, রাস্তাঘাট। তবে পুরসভা হওয়ার পরেও কোনও পুরবোর্ডই শহরের রাস্তাঘাট চওড়া করা বা সম্প্রসারণে সফল হয়নি। অভিযোগ এর পিছনে রয়েছে রাজনীতি। আর জনমোহিনী সেই রাজনীতির ফলে প্রধান রাস্তাগুলি হয়েছে সংকীর্ণ। যানবাহন আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়ে সেই সঙ্কটকে আরও প্রকট করেছে।

কিছু পুরবাসীর মত, শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডেই পাকা রাস্তা, পর্যাপ্ত নিকাশি, পথবাতি, আধুনিক বাজার, বাসস্ট্যান্ড, বাড়ি বাড়ি পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা চালু থাকলেও যানজট-ই তাঁদের প্রধানতম দুর্ভোগের কারণ। তৃণমূল পরিচালিত পুরসভা আগামী দিনে কী ভাবে কৌশলে বিষয়টি সামাল দেয়, সে দিকেই তাকিয়ে বাসিন্দারা, ব্যবসায়ীরা।

ছবি: সোহম গুহ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement