কেশপুরের মহিষদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটের দীর্ঘ লাইন। —নিজস্ব চিত্র
পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর। নির্বাচনী ময়দানে কেশপুর থেকে গিয়েছে কেশপুরেই!
একটি ছোট্ট ঘটনা বাদ দিলে, কেশপুরে নির্বাচন হল রক্তপাতহীন। ওই ঘটনা বাদ দিলে, আর কোত্থাও কোনও সংঘর্ষ দূরের কথা, ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটেনি! তাই কেশপুরের ভোট নিয়ে ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী মানস ভুঁইয়ার বক্রোক্তি, “শ্মশানের শান্তির ভোট হয়েছে।” আর সিপিএম নেতা ইন্তাজ আলির কথায়, “অবাধ ছাপ্পা হয়েছে।”
কেশপুর বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৮৭.২৫ শতাংশ। কেশপুরে ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত। কেশপুর বিধানসভায় ২৭৩টি বুথ। যার মধ্যে কেবলমাত্র মাজুরহাটি বুথ থেকে সিপিএমের এজেন্টকে সরাতে একবার মারামারির ঘটনা ঘটল। মুহুর্তে পুলিশ গিয়ে বন্ধও করল মারামারি। তারই মধ্যে অবশ্য দু’পক্ষের ৮ জন আহত হন। উদ্দেশ্য সাধন হল। সিপিএমের এজেন্ট শেক মফিজুদ্দিন আহত হয়ে হাসপাতালে। বুথ ফাঁকা। বাকি যে সমস্ত বুথে তখনও কংগ্রেস ও সিপিএমের এজেন্ট ছিলেন, তাঁদের নরম সুরে ধমক দিতেই বেশিরভাগই বুথ ছেড়ে পালালেন। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের বড় জোর শ’খানেক বুথে এজেন্ট ছিল। আর বামফ্রন্টের এজেন্ট ছিল ৪০টির মতো বুথে। অভিযোগ, সেই সুযোগেই অবাধ ছাপ্পা দিল শাসক দল।
কেশপুরের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কোনও রকম নির্দেশ অমান্য করা হয়নি। প্রায় প্রতিটি বুথেই ছিল আধা সামরিক বাহিনী। ন্যুনতম ৪ জন। সাঁ সাঁ করে ঘুরে বেড়িয়েছে সেক্টর অফিসের টহলদারি গাড়ি, থানার টহলদারি গাড়িও। কেশপুর, সরুই, নেড়াদেউল, মুগবসানের মতো রাস্তার ধারের বুথের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, প্রত্যন্ত এলাকা বাজুয়াড়া, কেওটপাড়া, ঘাটা-জামবনি, বাজিরচকের মতো বুথেও আধা সামরিক বাহিনী বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। ভোট দিয়ে বেরিয়ে লক্ষীকান্ত অধিকারী বলেন, “বিরোধী নেই তো, তাই গণ্ডগোলও নেই। শান্তিতে ভোট দিয়ে চলে এলাম।”
এত বজ্র আঁটুনির মাঝেও বুথ দখল, ছাপ্পা! খালি চোখে অবিশ্বাস্যই মনে হয়।
তবু হয়েছে। বুথ থেকে অনেক দুরে। বাড়িতে, পাড়ায়। অভিযোগ, আগের দিন রাতেই প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে, “বুথে যেতে হবে না। সচিত্র পরিচয়পত্র আমাদের দিয়ে দে।” না দিলে? হুমকি, “ভোটের পর কোথায় যাবি? এখানেই থাকতে হবে তো!” স্নায়ুর চাপ সহ্য করতে পারেননি বেশিরভাগ মানুষ। এমনকি গুনহারা গ্রামের একরোখা বামপন্থী কর্মী মসিবুল রহমান থেকে পোলিং এজেন্ট শেখ মোজাহার আলিও দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদেরটা নিতে রাজি হয়নি তৃণমূল। দু’জনেই ভয়ে গ্রাম ছেড়ে কেশপুরে জামসেদ আলি ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। মসিবুলের কথায়, “গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমি পঞ্চায়েত থেকে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার স্ত্রী সালমা বিবি পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী হয়েছিল। আমারটা নাম কেটে গেলেও স্ত্রীর নামটা থেকে যায়। তাই আমি সচিত্র পরিচয়পত্র দিয়ে আত্মসমর্পণ করব বললেও ওরা নেয়নি।”
আর যাঁরা আত্মসমর্পণ করেননি? তাঁদের জন্য ছিল অন্য রাস্তা। বুথ থেকে কমিশন নির্দিষ্ট করা দুরত্বেই তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। যে পথ দিয়ে বুথে আসতে হবে সেই পথেই একাধিক জায়গায় জটলা তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের। তীক্ষ্ন নজরদারি পেরিয়ে কারও যাওয়ার উপায় নেই। রাস্তার ধারে জটলা বাহিনীতে থাকা এক তৃণমূল নেতাকে দেখে রসিকতা করে জিগ্যেসই করা গেল, “সিপিএমের ভালোই তো ভোট পড়ছে, কী বলুন?” নেতার উত্তর, “গণনার পর দেখে নেবেন, ওই বুথে কারা ক’টা ভোট পেল।” বুথের ভেতরে থাকা আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গে কথা হল। তাঁদের মধ্যে এ রাজ্যের এক যুবকও রয়েছেন। বুথের ভেতরে শান্তি, জানিয়ে দিলেন জওয়ানেরা। কিন্তু বাইরে? এক জওয়ানের আফশোস, “বাইরে যা হচ্ছে তা কহতব্য নয়। কিন্তু বাইরে তো আমাদের কাজ নেই।” বাইরে যে দায়িত্ব রয়েছে রাজ্য পুলিশেরই। সেখানেই তো বাজিমাত করে দিয়েছে তৃণমূল।
বাম আমলেও একইভাবে ভোট করার অভিযোগে সোচ্চার হত বিরোধীরা। আর তৃণমূল জমানাতেও একইভাবে সোচ্চার বামফ্রন্ট। জামশেদ আলি ভবনে বসে সিপিএম নেতা ইন্তাজ আলি হিসাব কষছেন, কোন বুথে তাঁদের কতজন ভোটার ভোট দিতে পেরেছেন। বাকি বুথে পুণনির্বাচনের দাবি জানাবেন। আর বাম জমানায় তৃণমূল যেভাবে অভিযোগ করত, সেই সুরেই বলছেন, “এজেন্টদের জোর করে বের করে দিয়েছে। অনেককে বুথেই ঢুকতে দেয়নি।” আর কেশপুর ব্লক কংগ্রেস অফিসে বসে প্রাথমিক হিসাব কষে কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়া জানালেন, “মুখ্যমন্ত্রী সবংয়ের সভায় জানিয়েছিলেন, আমাকে পুঁতে দেবেন। প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পুরস্কার পাওয়ার আশায়, কেশপুরে এভাবে ভোট করিয়ে আমার পোঁতার চেষ্টা করল।” আর দলীয় কার্যালয়ে বসে বাম জমানায় সিপিএম নেতাদের মতোই উত্তর দিচ্ছেন বর্তমান শাসক দল তৃণমূলের কেশপুর ব্লকের সভাপতি সঞ্জয় পান, “সর্বত্রই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে। কারও এজেন্ট দেওয়ার লোক না থাকলে আমরা কী করতে পারি।”