ময়নায় বলি তিন শিশু

বাড়িতে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ

পরপর দুর্ঘটনাতেও হুঁশ ফেরেনি। বন্ধ হয়নি বেআইনিভাবে বাজি তৈরির কাজ। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় যে কোনওরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিয়েই বাজি তৈরির কাজ চলছে, তা ফের প্রকাশ্যে এল ময়নায় ঘটনায়। এ বার এই অসতর্কতার বলি একই পরিবারের তিন শিশু। সোমবার সকালে ময়না থানার শ্রীকন্ঠা এলাকার উত্তমপুর গ্রামে বেআইনিভাবে বারুদ নিয়ে বাজি বাঁধার সময় বিস্ফোরণ ঘটে মৃত্যু হল একই পরিবারের তিন শিশুর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তমলুক শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন শিশুদের মায়েরা। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

পরপর দুর্ঘটনাতেও হুঁশ ফেরেনি। বন্ধ হয়নি বেআইনিভাবে বাজি তৈরির কাজ। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় যে কোনওরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিয়েই বাজি তৈরির কাজ চলছে, তা ফের প্রকাশ্যে এল ময়নায় ঘটনায়। এ বার এই অসতর্কতার বলি একই পরিবারের তিন শিশু। সোমবার সকালে ময়না থানার শ্রীকন্ঠা এলাকার উত্তমপুর গ্রামে বেআইনিভাবে বারুদ নিয়ে বাজি বাঁধার সময় বিস্ফোরণ ঘটে মৃত্যু হল একই পরিবারের তিন শিশুর। গুরুতর আহত ওই পরিবারের এক মহিলা।

Advertisement

গত বছর পুজোর আগে পাঁশকুড়ার হাউর এলাকার পুলশিটা গ্রামে মাজি পরিবারে বাজি বাঁধার সময় বিস্ফোরণ ঘটে মৃত্যু হয় এক গৃহবধূ ও তাঁর ছেলের। ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ওই পরিবারের আরও চার জন সদস্য। এর আগেও একাধিকবার বাজি বাঁধতে গিয়ে প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনার পরে প্রশাসনিক তৎপরতা দেখা গেলেও বাস্তবে যে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি, তা ফের প্রমাণ হল। পুলিশ ও জেলা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বিস্ফোরণে ছ’মাস বয়সের অরণ্য, বছর দু’য়েকের সনাতন ও সোনালির মৃত্যু হয়। সোনালি পাঁচ বছর বয়সী।

মৃতদের নাম সনাতন মণ্ডল, অরণ্য মণ্ডল ও সোনালী মণ্ডল। সনাতনের বয়স দু’বছর, অরণ্যের বয়স ছ’মাস। সোনালি ছয় বছর বয়সী। বারুদের বিস্ফোরণে আহত বছর পঞ্চাশের ছবি মণ্ডলও আশঙ্কাজনক অবস্থায় তমলুক জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

Advertisement

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শ্রীকণ্ঠা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা দীপক মণ্ডলের পরিবারে দীপকবাবুর স্ত্রী ও দুই পুত্রবধূ বেআইনিভাবে বাজি তৈরির কাজ করতেন। দীপকবাবুর বড় ছেলে লক্ষ্মীকান্ত বাবার সাথে দিনমজুরের কাজ করেন। ছোট ছেলে ভোলানাথ কাজের সূত্রে মুম্বইতে থাকেন। বাজি ব্যবসায়ীরা বাজি তৈরির জন্য ওই পরিবারের কাছে বারুদ ও অন্য সামগ্রী দিয়ে যেত। সেই বারুদ দিয়ে বাজি তৈরি করে তাঁরা বাজি ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিত। স্থানীয় বাসিন্দা শীতল মণ্ডল বলেন, “কয়েকমাস হল ওঁদের পরিবার বাজি তৈরির কাজ করছে। কিন্তু ওঁরা যেভাবে উনুনের কাছে বাজি তৈরি করছিল, তা খুবই বিপজ্জনক।”

দীপকবাবুর পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ১১টা নাগাদ বাড়ির এক তলায় রান্নাঘরে উনুন জ্বেলে ভাত রান্না চলছিল। উনুনের পাশে ফুট পাঁচেক দূরেই বারুদ নিয়ে বাজি (গুলি পটকা) তৈরি করছিলেন ছায়াদেবী। পাশেই দোলনায় ছিল তাঁর নাতি অরণ্য। আর ছায়াদেবীর পাশেই মাদুরে ঘুমোচ্ছিল তাঁর আর এক নাতি সনাতন। সেই সময় ছায়াদেবীর নাতনি সোনালি উনুনে জ্বালানি দিতে যায়। উনুন থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে পাশেই থাকা বারুদের উপর গিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে বাড়িতে আগুন ধরে যায়। সেই সময় বাড়ির অন্য জায়গায় ত্থাকা ছবিদেবীর দুই বৌমা বাইরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু আগুনে তিন শিশু-সহ ছায়াদেবী বাড়িতেই আটকে পড়েন। তাঁদের চিৎকারের শব্দ শুনে স্থানীয় বাসিন্দারা ছুটে এসে পুকুরের জল তুলে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। বাড়ির ভিতরে থাকা গুরুতর জখম তিন শিশু ও ছায়াদেবীকে কোনওরকমে উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের প্রথমে ময়না ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে। পরে তাঁদের সবাইকে তমলুক জেলা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। জেলা হাসপাতালেই লক্ষ্মীকান্তের ছেলে অরণ্য, মেয়ে সোনালি, ও ভোলানাথের ছেলে সনাতনের মৃত্যু হয়। ছায়াদেবী জেলা হাসপাতালের বার্ন ওয়ার্ডে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সন্তানদের হারিয়ে এ দিন হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন ছায়াদেবীর বড় বৌমা বন্দনাদেবী ও ছোট বৌমা কাকলিদেবী।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিস্ফোরণের ঘটনার পরে দীপকবাবু ও তাঁর ছেলে লক্ষ্মীকান্ত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারাই আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। দীপকবাবু ও তাঁর দুই ছেলে তখনও হাসপাতালে আসেননি বেল জানা গিয়েছে। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশী যুবক সুরজিৎ বেরা বলেন, “এ দিন সকালে আমি মাঠে ধান রোয়ার কাজ করছিলাম। আচমকা দীপক মণ্ডলের বাড়িতে আগুন লেগেছে বলে শুনতে পাই। চিৎকারের শব্দ শুনে ছুটে এসে দেখি, বাড়ির ভিতরে দাউদাউ আগুন জ্বলছে। সবাই মিলে জল ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। পরে বাড়ির ভিতরে আটকে থাকা ওই চার জনকে উদ্ধার করা হয়। তবে ততক্ষণে আগুনে পুড়ে সকলের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে।” ওই পরিবারের আত্মীয় মিনতি মান্না বলেন, “ছায়াদেবী বাজি তৈরির কাজ করত। আর কেউ করত কি না জানা নেই। ওঁরা কিছুদিন আগে আমাকেও বাজি তৈরির কাজ করতে বলেছিল। কিন্তু আমি রাজি হয়নি। আজ যে ঘটনা ঘটল, তা থেকে খুব শিক্ষা পেলাম।”

প্রশ্ন উঠছে, বেআইনিভাবে বাজি তৈরির রমরমা বন্ধে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?

শ্রীকন্ঠা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান সরস্বতী বাইচার বলেন, “আমি বিডিও অফিসে একটি বৈঠকে থাকার সময় ওই দুর্ঘটনার খবর পেয়েছি।” তাঁর সাফাই, “ওই পরিবার যে বেআইনিভাবে বাজি তৈরি করত, তা আমাকে কেউ জানায়নি।” এ দিন বিকেল তিনটে নাগাদ তমলুক দমকল কেন্দ্রে ফোন করা হলে কর্তব্যরত এক কর্মী, ময়নার ওই গ্রামে বাজি থেকে আগুন লাগার কোন ওখবর আসেনি বলে জানান। পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুকেশকুমার জৈন বলেন, “ময়নার ওই গ্রামে বেআইনিভাবে বাজি বাঁধার সময়ই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু ওই এলাকায় বেআইনিভাবে বাজি তৈরি বন্ধে আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? জেলা পুলিশ সুপারের দাবি, এধরনের কাজের খবর পেলেই অভিযান চালানো হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement