পর্যটনে সুদিন আসবে, আশায় মহিষাদল

সেটা ১৯৭৫ সাল। মহিষাদল রাজবাড়িতে শুটিং চলছিল ‘দত্তা’ সিনেমার। আর শুটিংয়ের ফাঁকে সুচিত্রা সেনকে দেখতে ভিড় উপচে পড়েছিল রাজবাড়ির সামনে। কাট টু ২০১৪। তামিল ছবির অনুকরণে বাংলা পর্দায় এল কোয়েল মল্লিকের ‘অরুন্ধতী’। আর সেই সিনেমার শু্যটিংও হল মহিষাদল রাজবাড়িতে। রাজপরিবারের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী, তৈলচিত্র, শিকার করা বিভিন্ন পশুপাখি-সহ রাজাদের বিশাল মহল, মন্দিরে ঘেরা মহিষাদল রাজবাড়ি বহু দিন ধরেই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে অত্যন্ত পছন্দের।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস

মহিষাদল শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:২৪
Share:

মহিষাদল রাজবাড়ির সংগ্রহশালায় কামান। ছবি:আরিফ ইকবাল খান।

সেটা ১৯৭৫ সাল। মহিষাদল রাজবাড়িতে শুটিং চলছিল ‘দত্তা’ সিনেমার। আর শুটিংয়ের ফাঁকে সুচিত্রা সেনকে দেখতে ভিড় উপচে পড়েছিল রাজবাড়ির সামনে।

Advertisement

কাট টু ২০১৪। তামিল ছবির অনুকরণে বাংলা পর্দায় এল কোয়েল মল্লিকের ‘অরুন্ধতী’। আর সেই সিনেমার শু্যটিংও হল মহিষাদল রাজবাড়িতে।

রাজপরিবারের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী, তৈলচিত্র, শিকার করা বিভিন্ন পশুপাখি-সহ রাজাদের বিশাল মহল, মন্দিরে ঘেরা মহিষাদল রাজবাড়ি বহু দিন ধরেই চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে অত্যন্ত পছন্দের। আবার এমন একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন টেনে এনেছে বহু পর্যটককেও। তবে শুধু এই রাজবাড়িই নয়, মহিষাদলের ভাঁড়ারে রয়েছে বহু দর্শনীয় স্থানও। যেমন মহিষাদলের কাছেই গেঁওখালি, হিজলি টাইডাল ক্যানালের পাশে রয়েছে গান্ধী কুটির-এমনই নানা কিছু। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে সেভাবে পর্যটক টানতে পারছে না এই পর্যটনকেন্দ্রগুলি।

Advertisement

মহিষাদলের রাজবাড়ির ইতিহাস বহু প্রাচীন। মহিষাদল রাজ পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ষষ্ঠদশ শতকে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা ব্যবসায়ী জনার্দন উপাধ্যায় ব্যবসার কাজে এসেছিলেন মহিষাদলের সন্নিকটে গেঁওখালিতে। পরে তিনি তৎকালীন মহিষাদল এলাকার রাজা কল্যাণ রায়চৌধুরির কাছ থেকে মহিষাদলের রাজত্ব কিনে নেন। সেই রাজবাড়ি এখন আর নেই। ১৮৪০ সালে নির্মিত রঙ্গিবসান রাজপ্রাসাদের চারদিক একসময় পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল। এখন সেই পরিখা মজে গিয়েছে। রাজপ্রাসাদে লোকজন বসবাস করেন এবং সেটিও সংস্কারের অভাবে বেহাল।

১৯৩৪ সালের তৈরি ফুলবাগ রাজবাড়িই এখন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। রাজবাড়িতে শুধু রাজ আমল নয়, ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। ফুলবাগ রাজপ্রাসাদের একতলায় রাজপরিবারের পক্ষ থেকে সংগ্রহশালা করা হয়েছে। ২০১২ সালে ৩০ জুলাই তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু আধিকারী এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। রাজপ্রাসাদের পাঁচটি ঘরে সযত্নে রাখা রয়েছে রাজপরিবারের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী, নানা চিঠিপত্র, তৈলচিত্র, নানা ছবি। অন্য ঘরে ঢাল, তরবারি থেকে শুরু করে রাজ সেনাদের নানা অস্ত্র, পোষাক রাখা হয়েছে। মহিষাদল রাজবাড়ির সংগ্রহশালার এক কেয়ারটেকার জানান র্যটকদের জন্য প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত সংগ্রহশালা খোলা থাকে। আর এখানকার প্রবেশমূল্য মাত্র ১০ টাকা।

রঙ্গিবসান প্রাসাদের কাছেই রয়েছে রাজপরিবারের তৈরি গোপাল জিউ মন্দির। মহিষাদলের রানি জানকীদেবী ১৭৭৮ সালে এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। তাছাড়াও মহিষাদলের রামবাগে ১৭৮৮ সালে তিনি রামজিউ মন্দির তৈরি করেন। কিন্তু রামজিউ মন্দির বর্তমানে সংস্কারের অভাবে বেহাল হয়ে পড়ে রয়েছে। মহিষাদল রাজপরিবারের সদস্য শঙ্করপ্রসাদ গর্গের কথায়, “মহিষাদল রাজবাড়িতে পর্যটনকেন্দ্র গড়া নিয়ে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কোনও প্রস্তাব আসেনি। তবে এলে আমরা আলোচনা করে দেখব।” সঙ্গে তাঁর আফশোস, “এত বড় সম্পত্তি দেখভালের জন্য বিপুল খরচের প্রয়োজন। সেকারণেই সরকারি সাহায্য পেলে উপকার হবে।”

রাজবাড়ি ছাড়াও মহিষাদলের সন্নিকটে গেঁওখালিতে হুগলি, রূপনারায়ণ ও দামোদর নদের ত্রিবেণি সঙ্গম রয়েছে। সঙ্গমের মনোরম পরিবেশ দেখতেও অনেকে ভিড় করেন। কিন্তু সেখানে অবসর যাপনের জন্য না রয়েছে কোনও পার্ক, না রয়েছে বিনোদনের উপায়। ভরসা বলতে সেই পুরনো রঙ্গিবসান রাজপ্রাসাদের আমবাগান। মহিষাদল রাজবাড়ি থেকে ঢিলছোড়া দুরত্বে এক্তারপুরে হিজলি টাইডাল ক্যানালের পাশে রয়েছে গান্ধী কুটির। ১৯৪৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী মহিষাদলে এসে এখানে কাটিয়ে গিয়েছিলেন দিন চারেক। মহিষাদলের গ্রাম গোপালপুরে স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশ সামন্তের বাড়ি রয়েছে। পরাধীন ভারতে স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের প্রথম সর্বাধিনায়ক ছিলেন সতীশ সামন্ত। গোপালপুরে সতীশবাবুর বাড়িতে তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন।

শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, এত সুন্দর জায়গা থাকা সত্ত্বেও মহিষাদলে উপযুক্ত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। মহিষাদলের সিনেমা মোড়ের বাসিন্দা সিদ্ধার্থ সিংহ বলেন, “রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে মহিষাদলকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুললে এলাকার উপকার হবে। পর্যটকরা এলে এখানকার অর্থনীতির ছবিটা বদলে যাবে।” মহিষাদলের গৃহবধু রেখা দাসের কথায়, “মহিষাদলের মত বর্ধিষ্ণু জায়গায় পার্ক নেই। ভরসা বলতে পুরানো রাজবাড়ি চত্বর।” পর্যটন দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্ব মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক (ট্রেজারি) প্রশান্ত অধিকারী বলেন, “তমলুক রাজবাড়ি, বর্গভীমা মন্দির, ময়না রাজবাড়ি, মহিষাদলের গেঁওখালির ত্রিবেণি সঙ্গম থেকে শুরু করে মহিষাদল রাজবাড়ি ও হলদিয়াকে নিয়ে একটি পর্যটন সার্কিট হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে জেলা থেকে রাজ্যের পর্যটন দফতরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নির্দেশ পেলেই আমরা রিপোর্ট তৈরি করব।”

মহিষাদল রাজবাড়ি সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজাদের প্রায় ৬৯ একর জমি খাস হয়ে গিয়েছে। তার অধিকাংশ জমি রাজবাড়ি চত্বরে রয়েছে। সেই সরকারি জমি আবার রাজ্যের ভূমি দফতরের হাতে রয়েছে। ইতিমধ্যে এলাকার পরিকাঠামোগত উন্নয়নে সেই জমি হস্তান্তর চেয়ে হলদিয়া উন্নয়ন সংস্থা আবেদন করেছে। আবার মহিষাদল রাজবাড়িতে ফিল্ম-সিটি করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন রাজ পরিবারের সদস্য শৌর্যপ্রসাদ গর্গ। হলদিয়া উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান তথা তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ মহিষাদলের রাস্তা, রবীন্দ্র পাঠাগার, সতীশ সামন্তের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা তৈরি করেছে। রাজবাড়ি চত্ত্বরের যে খাস জমি ভূমি দফতরের নামে রয়েছে, তা হস্তান্তরের জন্য ভূমি দফতরের কাছ থেকে এইচডিএর পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়েছে। পরিকাঠামোগত উন্নয়নে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।”

পর্যটনের পালে হাওয়া লাগবে, সেই আশাতেই বুক বাঁধছে মহিষাদল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement