দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখছে না বামেরা

৪৪ থেকে ৩৪ থেকে ২৯। শতাংশের হিসেবে গত তিনটি নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হার এ ভাবেই কমছে। লোকসভা ভোটের ফল যে ভাল হবে না, তা আগাম আঁচ করেছিলেন বাম নেতৃত্ব। কিন্তু ভরাডুবি যে এই পর্যায়ে পৌঁছবে, তার আঁচ পাননি তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে এখনই ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ সম্ভব নয় বলে মেনে নিচ্ছেন বাম নেতৃত্ব। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আমাদের সমর্থন করেননি। তাই এই ফল হয়েছে। আমরা ফলাফলের পর্যালোচনা করব।”

Advertisement

বরুণ দে

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৪ ০০:৪৫
Share:

৪৪ থেকে ৩৪ থেকে ২৯। শতাংশের হিসেবে গত তিনটি নির্বাচনে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হার এ ভাবেই কমছে। লোকসভা ভোটের ফল যে ভাল হবে না, তা আগাম আঁচ করেছিলেন বাম নেতৃত্ব। কিন্তু ভরাডুবি যে এই পর্যায়ে পৌঁছবে, তার আঁচ পাননি তাঁরা।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে এখনই ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ সম্ভব নয় বলে মেনে নিচ্ছেন বাম নেতৃত্ব। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আমাদের সমর্থন করেননি। তাই এই ফল হয়েছে। আমরা ফলাফলের পর্যালোচনা করব।” ২৯ শতাংশ ভোট নিয়ে কি এখনই ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ সম্ভব? সদুত্তর এড়িয়ে দীপকবাবুর জবাব, “ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। তৃণমূলের লোকেদের হাতে বাম কর্মী-সমর্থকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাদের আপাতত লক্ষ্য, এই প্রতিকূল পরিস্থিতি ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা।”

জেলায় বাম-বিপর্যয় শুরু পালাবদলের বছর অর্থাৎ ২০১১ সাল থেকে। তবে ওই বছর ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বামেরা। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তা কমে হয় ৩৪ শতাংশ। একদা ‘লালদুর্গে’ মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে ১০ শতাংশ ভোট কমায় দলের অন্দরে অনেকে উদ্বিগ্ন হন। পরবর্তী সময় এ নিয়ে দলীয় স্তরে পর্যালোচনাও হয়। বাম নেতৃত্ব মনে করেছিলেন, পঞ্চায়েতের তুলনায় লোকসভায় ভোট বাড়বে। অন্তত ৪-৫ শতাংশ। ফলপ্রকাশের পর অবশ্য দেখা যাচ্ছে, ৫ শতাংশ ভোট কমে গিয়েছে। এ বার লোকসভায় জেলায় বামেদের প্রাপ্ত ভোট ২৯ শতাংশ।

Advertisement

বিধানসভা ওয়াড়ি হিসেবও পুরোদস্তুর বামেদের প্রতিকূলে। পশ্চিম মেদিনীপুরে মোট ১৯টি বিধানসভা আসন। সদ্য প্রকাশিত লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখি জেলায় মাত্র একটি বিধানসভা আসনে এগিয়ে বামেরা। সেটি আবার কংগ্রেসের খাসতালুক সবং। ব্যবধানও মাত্র ৬৮টি ভোটের। ২০১১ সালের নির্বাচনে এই ১৯টি বিধানসভার মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ৮টি, বামেরা ৯টি, কংগ্রেস ২টি। লোকসভার নিরিখে এ বার ১৭টি বিধানসভাতেই এগিয়ে তৃণমূল। একটিতে বিজেপি। সেটি খড়্গপুর সদর। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের নির্বাচনী এলাকা নারায়ণগড়ে বামেরা পিছিয়ে রয়েছে ২৬ হাজার ভোটে।

কেন এই ভরাডুবি? বাম নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, বিস্তীর্ণ এলাকায় সংগঠন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক কমিটি শুকিয়ে গিয়েছে। ফলে, বিস্তারের কাজ ব্যাহত হয়েছে। অনেকে এলাকায় নতুন মুখের অভাব রয়েছে। যে সব নেতা-কর্মীদের মানুষ দেখতে চান না, এখনও তাঁরাই দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফলে, সমর্থন ক্ষয়ে যাচ্ছে। জেলা সিপিএমের এক নেতার মতে, একেবারে নীচের তলার কমিটি অর্থাৎ প্রাথমিক কমিটিকে জীবন্ত রাখতে না পারলে সাধারণ সদস্যদের সঙ্গে সংযোগ শুকিয়ে যায়। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনোত্তর পর্বে এই কাজটিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু তাতে যে সাফল্য আসেনি, তা বলাই বাহুল্য। আপাতত, বুথ ভিত্তিক সংগঠনে নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বাম নেতৃত্বের একাংশ।

লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে জেলায় বামেদের সর্বাধিক সমর্থন কমেছে ঝাড়গ্রাম অর্থাৎ জঙ্গলমহলে। মেদিনীপুরে বামেরা পেয়েছে ৩১ শতাংশ ভোট, তৃণমূল ৪৬ শতাংশ, বিজেপি ১৪ শতাংশ। ঘাটালে বামেরা পেয়েছে ৩১ শতাংশ ভোট, তৃণমূল ৫০ শতাংশ, বিজেপি ৭ শতাংশ। অন্য দিকে, ঝাড়গ্রামে বামেরা পেয়েছে ২৬ শতাংশ ভোট, তৃণমূল ৫৪ শতাংশ, বিজেপি ১০ শতাংশ। বাম নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, এক সময় জঙ্গলমহলে যে বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী খুন হয়েছিলেন, তার ফলে তৈরি হওয়া শূন্যতা এখনও পূরণ হয়নি। জঙ্গলমহলে অশান্তি-পর্বে বামেদের আড়াইশোরও বেশি নেতা-কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছেন। পঞ্চাশ জনেরও বেশি কর্মী- সমর্থক নিখোঁজ রয়েছেন। খুন হয়েছেন অনন্ত মুখোপাধ্যায়, অনিল মাহাতো, তপন মাহাতোর মতো নেতা- কর্মীরা। সিপিএম সূত্রের খবর, শুধুমাত্র ঝাড়গ্রাম ব্লকেই ৭২ জন সিপিএম নেতা-কর্মী খুন হয়েছিলেন। ২৪ জন এখনও নিখোঁজ। জেলা সিপিএমের এক নেতা মানছেন, “এত সংখ্যক নেতা-কর্মীর অনুপস্থিতি দলের মধ্যে শূন্যতা তৈরি করেছে। এই শূন্যতা চটজলদি পূরণ করা অসম্ভব।”

এই পরিস্থিতিতে সংগঠন পুনরুদ্ধারে নতুন কর্মী তৈরি এবং দলের বিকেন্দ্রীকরণে জোর দিতে হবে বলে মনে করছেন বাম নেতৃত্ব। জেলা স্তরের এক সিপিএম নেতার কথায়, “নতুন কর্মী তৈরি করতে হবে। তার আগে দলকে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। কখনও প্রকাশ্যে কাজ হবে, কখনও গোপনে।” অবশ্য চটজলদি ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ সম্ভব নয় বলে মানছেন তিনিও। তাঁর কথায়, “রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টানো অসম্ভব।” একই সঙ্গে বাম নেতৃত্ব জানাচ্ছেন, প্রতিকূলতার মধ্যেই সম্ভাবনার উপাদান লুকিয়ে থাকে। সেই উপাদানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। যে ত্রুটিগুলোর ফলে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, সেগুলো কাটাতে হবে। প্রয়োজনে সংশোধন করতে হবে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।

বাম নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, দ্রুত দলের কিছু মুখ বদলানো জরুরি। তা করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে কর্মীদের লড়াইয়ে রাখা সহজ হবে না। অবশ্য দলের অন্দরের খবর, এখনই মুখ বদলের সম্ভাবনা কম। কয়েক মাস পরই সিপিএমের সম্মেলন শুরু হবে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই কিছু রদবদল হবে। কাউকে নির্বাচনী বিপর্যয়ের জন্য পদ থেকে সরতে হতে পারে। কাউকে সাংগঠনিক ব্যর্থতার জন্য পদ থেকে সরতে হতে পারে। জেলার এক বাম প্রার্থী বলছিলেন, “এই লোকসভা ভোটে কাজ করতে গিয়েও মনে হয়েছে, কিছু মুখকে দ্রুত সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের চেনা মুখ সরিয়ে নেতৃত্বে নতুন মুখ আনলে অন্তত একটা বার্তা দেওয়া যাবে। মানুষ বুঝবেন, বামেরাও সংশোধিত হচ্ছেন!”

আপাতত, তাহলে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র কোনও দাওয়াই নেই? বাম কর্মী-সমর্থকদের ফেসবুক-ওয়ালে অবশ্য ঘোরাফেরা করছে, ‘কিছুই কোথাও যদি নেই, তবু তো ক’জন আছি বাকি/ আয় আরও হাতে হাত রেখে, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement