খড়্গপুরে গজিয়ে উঠছে বহুতল। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
অলস দুপুরে বাড়ির দালানে বসে গল্প-গুজব কিংবা বাড়ির শখের বাগানে বিকেল বেলায় বন্ধুরা মিলে খেলাধূলা। হারিয়ে যাচ্ছে সে সব দিন। দু’মহলা বাড়ির থেকে ‘টু বিএইচকে’ ফ্ল্যাটের উপরই এখন নবীন প্রজন্মের বেশি ঝোঁক। আর আধুনিকতার সেই ট্রাডিশনে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে রেলশহর খড়্গপুরও।
১৮৯৮ সালে খড়্গপুরে এশিয়ার বৃহত্তম রেল কারখানা গড়ে ওঠার সময় থেকেই এই শহরে বসতি বাড়তে থাকে। কারখানায় কর্মসূত্রে অনেকেই সেই সময় শহরের প্রাণকেন্দ্র ও শহরতলিতে জলের দরে জমি কিনে বাড়ি করেন। পাশাপাশি, রেল কোয়ার্টারে কাজের সন্ধানে আসা তেলেগু, বিহারী, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা বসতি গড়ে তোলেন। শহরের জনসংখ্যা ক্রমে বাড়ায় নাগরিক পরিষেবার স্বার্থে গড়ে ওঠে পুরসভা। তবে বর্তমানে নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে শহর। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উল্কা গতিতে বাড়ছে জমির দামও। চড়া দাম দিয়ে জমি কিনে বাড়ি করার থেকে একটা ফ্ল্যাট কিনে নেওয়াই এখন নবীন প্রজন্মের অনেক বেশি পছন্দের। ফলে চাহিদা বাড়ায় শহরে বাড়ছে বহুতলের সংখ্যাও। ঝাপেটাপুরের একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা রেলকর্মী পার্থসারথী নন্দীর কথায়, “বেশ ভালই আছি। আমরা ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা মিলে একটা পরিবারের মতো কমিটি গড়েছি। ফ্ল্যাটের নিরাপত্তারক্ষীও আছে। ফলে এখন ছেলে মেয়ে বাইরে থাকলেও নিশ্চিন্তে বাড়ির বাইরে যেতে পারি।” তাঁর যুক্তি, “নিজের বাড়ি হলে সবাই মিলে একসাথে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া যেত না। তাছাড়াও এখন জমির যা দাম!”
বছর কুড়ি আগেও শহরে জমির দাম মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে ছিল। সেই সময় এক জন ছাপোষা সরকারি চাকুরেও নিজের একটা বাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখতেন। বর্তমানে বাড়ি করা চাড্ডিখানি কথা নয়। আকাশছোঁয়া দাম দিয়ে জমি না হয় কেনা গেল, তারপর ফের মোটা টাকা খসিয়ে বাড়ি তৈরি করার কথা ভাবলেই মধ্যবিত্তের রক্তচাপ বেড়ে যায়। তবে বাড়ি তৈরির সংস্কৃতিও একেবারে হারিয়ে যায়নি। শহরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মী শিশিরকুমার সরকার বলেই ফেললেন, “আমাদের কাছে বাড়িই ভাল। নিজের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে চলা যায়। ফ্ল্যাট সংস্কৃতির সঙ্গে ঠিক মানিয়ে নেওয়া যায় না।” ফ্ল্যাট সংস্কৃতির রমরমা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা, “বর্তমানে যে হারে জমির দাম বাড়ছে, তাতেই নবীন প্রজন্ম ফ্ল্যাটের প্রতি আরও বেশি করে ঝুঁকছে।” তবে শুধু বাড়ি নয়, বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স তৈরির জন্যও বহুতলের চাহিদা রয়েছে। ফলে রমরমা বাড়ছে প্রোমোটারদেরও।
কয়েক বছর আগেও উত্তরে তলঝুলি, গোপালনগর, বুলবুলচটি, ঝুলি, দক্ষিণে ভবানীপুর, রাজগ্রাম, কুমোরপাড়া, পূর্বে রামকৃষ্ণপল্লি, সারদাপল্লি, সাঁজোয়াল, বিদ্যাসাগরপুর, পশ্চিমে বালাজি মন্দিরপল্লি, সুষমাপল্লি, ঢেকিয়া এলাকায় রেলশহরের পরিধি বাড়ছিল। তখন মূলত শহরতলির ওই সমস্ত এলাকায় জমি কিনে বাড়ি তৈরির রেওয়াজ ছিল। তবে গত কয়েক বছরে জমির দর আকাশছোঁয়া হয়েছে। তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জমি দালালদের রমরমা। ফলে বাড়ি ক্রমশ ব্রাত্য হয়েছে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে। জমি বেচা-কেনার কারবারে যুক্ত শহরের বাসিন্দা অপু চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, কলকাতায় তো বর্গফুটে জমি বিক্রি হচ্ছে। খড়্গপুরে এখনও সেই পরিস্থিতি আসেনি। তবে জমির দাম আগের থেকে দশ গুণ বেড়েছে। অনেকক্ষেত্রে বহুতল নির্মাণের জন্য মানুষ কিছু শর্তে স্বেচ্ছায় জমি দিচ্ছেন। তবে এখনও বাড়ি তৈরির সংস্কৃতি একেবারে হারিয়ে যায়নি।
শহরের রাজগ্রাম এলাকায় দশ বছর আগেও ডেসিমেল প্রতি ২০ হাজার টাকায় জমি কেনা যেত। কিন্তু এখন সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ টাকায়। ইন্দার সারদাপল্লিতেও জমির একই দর। খরিদার কুমোরপাড়ার ভিতরে তেঘরিয়ার ঘিঞ্জি এলাকায় কয়েকবছর আগেও জমি সহজেই পাওয়া যেত। কিন্তু এখন সেখানেই প্রতি ডেসিমেল জমির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার টাকায়। আর ইন্দার নিউটাউন বা ঝাপেটাপুরের রাস্তার ধারের জমির দাম ১২ লক্ষে পৌঁছেছে। তাই ছোট জমির উপর বাড়ি তৈরির খরচেই আধুনিক সুবিধাযুক্ত ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়ছে। ফলে শহরের প্রান্তবর্তী নিউটাউন, জফলা রোড এমনকী খড়্গপুরের প্রাণকেন্দ্র ঝাপেটাপুর, মালঞ্চতেও গজিয়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল।
চাহিদা বাড়ায় চড়ছে ফ্ল্যাটের দামও। বছর সাতেক আগেও শহরে ১১০০ টাকা বর্গফুট হিসেবে ফ্ল্যাট পাওয়া যেত। এখন সেখানেই মার্বেল ফিনিস তিনটে বেডরুম, ডাইনিং হল, দু’টি বাথরুম, একটি রান্নাঘর যুক্ত ফ্ল্যাটের দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে বর্গফুট প্রতি ২৩০০ টাকায়। শহরের এক বহুতল নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত সংস্থার কর্ণধার উজ্জ্বল সেনগুপ্ত বলেন, “বর্তমানে জমির দাম বেড়েছে। তবে দাম দিয়েও বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সের জন্য ইন্দায় রাস্তার পাশে জমি পাওয়া সমস্যার।”
তবে শহরতলিতে জনবসতির বিস্তার হলেও পুর পরিষেবার মান উন্নত হয়নি বলে অভিযোগ। শহরের জনসংখ্যা অনুযায়ী বর্তমানে দৈনিক ১৬ মিলিয়ন লিটার পানীয় জল সরবরাহের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে মাত্র সাড়ে ৯ মিলিয়ন লিটার জল সরবরাহ হয়। অনেক এলাকায় আবর্জনা ফেলার জন্য পুরসভার ভ্যাটও নেই। পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পান্ডে বলেন, “নিকাশি ও বর্জ্য পরিষ্কার যে কোনও শহরের বড় সমস্যা। এটা এই শহরেও আছে মানছি। কিন্তু আমাদের সময়ে খড়্গপুর শহরে ১৬টি মহানালা নির্মাণ হয়েছে। আসলে পুরসভার উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে হয়।”