আর্থিক সমস্যা তৈরি হলেও আর বেআইনি ভাবে চোলাই মদ তৈরি বা মদের ব্যবসা করব না— অঙ্গীকার করলেন স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ৪৩ জন। এঁরা আর কেউ নন, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মদ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কোলাঘাটের দু’টি পাড়ার বাসিন্দা। সোমবার তাঁরা জেলাশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, আবগারি আধিকারিক ও কোলাঘাট পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির কাছে গণস্বাক্ষর-সহ চিঠি দিয়ে জানালেন, ‘আর ভুল নয়, এ বার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব।’
যা শুনে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক অন্তরা আচার্যের জবাব, “এটা ভাল পদক্ষেপ। ওরা যদি সত্যিই যদি নিজেদের ভুল বুঝে বেআইনি ব্যবসা থেকে পুরোপুরি নিজেদের সরিয়ে আনতে পারে, তা হলে সেটা একটা দৃষ্টান্ত। ওদের সাধুবাদ জানাচ্ছি।” জেলার অন্যত্রও বেআইনি মদ তৈরি ও ব্যবসা বন্ধে উদ্যোগী হবেন তিনি, বলছেন জেলাশাসক।
দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে চোলাই মদের ব্যবসা চলায় কোলাঘাটের পুলশিটা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার কুমারহাট গ্রামে দুটি পাড়ার লোকজন তো বটেই, অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন আশেপাশের বাসিন্দারাও। বেআইনি ওই মদ তৈরির বিরুদ্ধে আবগারি দফতর ও পুলিশের মাঝমাঝে তল্লাশি চালালেও এলাকার মানুষের অভিযোগ ছিল, ‘ও সব লোক দেখানো বই অন্য কিছু নয়’। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে খবর, কুমারহাট গ্রামের দুটি পাড়া মিলিয়ে ৫০টি পরিবার দীর্ঘ দিন ধরে চোলাই মদ তৈরি ও ব্যবসায় যুক্ত। মদের ভাটি থেকে বর্জ্য পুকুরে ও চাষজমিতে মেশায় এলাকার বহু কৃষকের ধান, ফুল ও পুকুরে মাছ চাষের ক্ষতি হচ্ছিল।
এ নিয়ে এলাকাবাসীর একাংশের ব্যাপক ক্ষোভও তৈরি হয়। মদের কারবারের প্রতিবাদ করার চলতি বছরের অগস্টে ওই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কমলকান্ত দোলইয়ের বাড়িতে নোংরা-আবর্জনা ফেলে রেখে ও পুকুরে কীটনাশক দিয়ে মাছ মারার অভিযোগ ওঠে চোলাই কারবারীদের বিরুদ্ধে। সে সময়ে কমলকান্তবাবু জেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়ে প্রতিকারের আর্জি জানান। একটি সূত্রের দাবি, তাতে সাড়া দিয়েই ওই এলাকায় চোলাই মদের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়তে সম্প্রতি স্কুল পড়ুয়া ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে পদযাত্রা করেছিলেন জেলাশাসক অন্তরা আচার্য, পুলিশ সুপার সুকেশকুমার জৈন-সহ আবগারি দফতরের আধিকারিকরা। পদযাত্রা শেষে কুমারহাট গ্রামের এক আলোচনা সভায় জেলাশাসক চোলাই মদ বন্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানোর পরে সভামঞ্চের কাছে এসেই জেলাশাসকের কাছে বিক্ষোভ দেখান চোলাই মদের কারবারি পরিবারের মহিলা সদস্যেরা।
অবশেষে সেই কুমারহাটের চোলাই ভাটি মালিকরাই এগিয়ে এলেন দীর্ঘ দিনের ব্যবসা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। হঠাৎ কী এমন হল, যার জন্য এই সিদ্ধান্ত?
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্রের দাবি, পুলিশ সুপার-জেলাশাসকের পদযাত্রার পর থেকেই মদ ব্যবসায়ীদের উপরে চাপ তৈরি হয়। আবগারি দফতর থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো শুরু হয়। পুলিশও সক্রিয় হয়। সম্প্রতি গ্রামের কয়েক জনকে হুমকি দেওয়া, খেতের ফসল নষ্ট করার অভিযোগে কোলাঘাট থানার পুলিশ ওই গ্রামের চার ভাটি মালিককে গ্রেফতার করে। ইতিমধ্যে গত রবিবার ওই এলাকার বাসিন্দারা জোট বেঁধে ‘পুলশিটা অঞ্চল মদ উচ্ছেদ কমিটি’ গঠন করেন।
স্থানীয়দের একাংশের দাবি, তারপরেই চাপের মুখে সোমবার ওই গ্রামের চোলাই মদের কারবারিরা সিদ্ধান্ত নেন, ‘আর মদ তৈরির ব্যবসা করবেন না।’ ওই গ্রামের বাসিন্দা সুমিত্রা সিংহ, সুকুমার সিংহ, গুরুপদ মাল, মিঠু মালিক-সহ ৪৩ জন চোলাই মদের কারবারি স্বাক্ষর করা একটি লিখিত প্রতিশ্রুতি জেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপার, জেলা আবগারি দফতর ও কোলাঘাট পঞ্চায়েত সমিতির কাছে দেন।
সুমিত্রা সিংহ, সুকুমার সিংহেরা বলেন, “বেআইনি ভাবে মদ তৈরি ও ব্যবসা করার ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষতির কথা বুঝতে পেরেছি। গ্রামের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এই সিদ্ধান্ত।” কুমারহাট গ্রামের বাসিন্দা সুজয় ঘাটা বলেন, “পরিবারগুলি বেআইনি কারবার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমরা খুশি। গ্রামের সার্বিক সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে আমরাও সাহায্য করব।”