রাজ্যে পালাবদলের পরে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘ সেই তালিকায় নতুন সংযোজন ঘাটাল।
ফেসবুকে রাজনীতির কথা বলেছেন, এই অভিযোগে কলেজে ঢুকে হেনস্থা করা হল অমিত রায় নামে অর্থনীতির এক প্রবীণ শিক্ষককে। তাঁকে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। ঘটনায় স্তম্ভিত শিক্ষক মহল। প্রতিবাদে সরবও বিভিন্ন মহল।
ঘাটাল কলেজের এমন ঘটনার প্রতিবাদে আজ, বুধবার প্রতিবাদ দিবস পালনের ডাক দিয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুটা। প্রহৃত অমিতবাবুও এই সংগঠনের সদস্য। ওয়েবকুটার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক বিমলকুমার দাস বলেন, “ঘাটাল কলেজে যে ঘটনা ঘটেছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কতিপয় ছাত্র যে ভাবে কলেজে ঢুকে ওই শিক্ষককে মানসিক নির্যাতন করেছে, তা অনভিপ্রেত। এ সব হতে পারে না। ঘটনায় জড়িত ছাত্রদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।” বিমলবাবু জানান, আজ, বুধবার সংগঠনের সদস্যরা কালো ব্যাচ পরে প্রতিবাদে সামিল হবেন।
শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় যাঁরা অভিযুক্ত, সেই ছাত্ররা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মী-সমর্থক বলেই পরিচিত। ওয়েবকুটার জেলা সম্পাদক বিমলবাবু অবশ্য বলেন, “এক জন ছাত্রের প্রথম পরিচয় সে ছাত্র। যে কোনও সংগঠন করে তা শিক্ষকেরা কখনওই দেখেন না। কোনও ছাত্র শিক্ষকের উপর চড়াও হবে, এটা ভাবা যায়?”
কী বলছে ছাত্র সংগঠনগুলো?
এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক সৌগত পণ্ডা বলেন, “তৃণমূল আমলে শিক্ষক নিগ্রহের দীর্ঘ তালিকায় এটি নিছক একটি সংযোজন মাত্র। শুধু ঘাটাল নয়, রাজ্যের সর্বত্রই এই সংস্কৃতি চলছে। টিএমসিপির কর্মীরা কলেজে ঢুকে গুণ্ডামি করছে। যেন দখলদারির রাজনীতি চলছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। প্রতিবাদে মুখ খুললে আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। সে যেই হোন, ছাত্র কিংবা শিক্ষক।” এবিভিপির জেলা সভাপতি স্বরূপ মাইতির প্রতিক্রিয়া, “টিএমসিপিকে দেখে ছাত্র সংগঠন বলে মনেই হয় না। ওটা তোলাবাজ-গুণ্ডাবাজদের সংগঠন। না হলে এ ভাবে কলেজের মধ্যে শিক্ষককে নিগ্রহ হতে হয়? ওদের এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি।”
ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি মহম্মদ সইফুল বলেন, “শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির দাপাদাপি চলছেই। আসলে শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা ওরা (টিএমসিপি) বোঝে না। যখন বুঝবে, তখন পিছন ফিরে দেখবে কেউ নেই। কলেজের মধ্যে শিক্ষককে হেনস্থা করা হবে? মারধর করা হবে? রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন ঘটনা থেকে তাও বোঝা যায়।” টিএমসিপির জেলা সভাপতি রমাপ্রসাদ গিরি বলেন, “ঘটনাটি নিন্দনীয়। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেন এমন হচ্ছে, ভাবা দরকার।” একই সঙ্গে তাঁর আশ্বাস, “সংগঠনের কেউ যদি এই ঘটনায় জড়িত বলে প্রমাণ হয়, তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সবে জেলায় ছাত্রভোট মিটেছে। ছাত্রভোটে এ বারও দাপট দেখিয়েছে টিএমসিপি। জেলার ২৬টি কলেজের মধ্যে ২৪টি কলেজের ছাত্র সংসদ পেয়েছে তারা। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদও হেলায় জিতে নিয়েছে তারা। জেলার ১৫টি কলেজে এ বার বিনা- যুদ্ধেই জয়ী হয় শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। এই সব কলেজে বিরোধী প্রার্থী ছিল না। বিনা যুদ্ধে জেতা কলেজগুলোর মধ্যে রয়েছে এই ঘাটাল কলেজও।
সম্প্রতি কাকদ্বীপে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা ঘটে। প্রজাতন্ত্র দিবসে স্কুলে জাতীয় পতাকা তোলার পরে দু’কথা বলতে গিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতির কথা টেনে এনেছিলেন এক স্কুল শিক্ষক। সেই কথায় রাজনীতির ছায়া দেখে অনুষ্ঠানের মধ্যেই তাঁকে বেধড়ক মারধর করেন শাসক দলের সমর্থকেরা। এমন নজির আরও রয়েছে। অথচ, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির দাপাদাপি যে একেবারে তাঁর পছন্দ নয়, রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পরে মহাকরণে দাঁড়িয়েই সেই বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী সংগঠনগুলি তা মনে করিয়ে দিয়ে বলছে, কে শোনে কার কথা!
জেলার এক কলেজ শিক্ষকের কথায়, “শিক্ষাক্ষেত্রে একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ছেদ পড়েনি। অথচ, তার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে কখনওই কড়া কথা শোনা যায়নি। কখনও ‘ছোট ছেলের ভুল’ বলে দায় এড়িয়েছেন। কখনও নীরব থেকেছেন। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে!” তাঁর কথায়, “এর শেষ কোথায়, সেটাই দেখার!”